ফিচারলাইফস্টাইলহোমপেজ স্লাইড ছবি
অতিথির গাড়ী বাইরে পার্ক করুন!

মঞ্জুর দেওয়ান: এক সময় বাড়িতে অতিথি আসলে শোরগোল পড়ে যেত। আগত কুটুমের আপ্যয়নে কোনটা রেখে কোনটা করবেন, তা ভেবে মাথার চুল পাঁকার উপক্রম হতো। এই ধরুন, দুপুরের খাবারে কি খাওয়াবেন, কোন মাছের ঝোল বেশি পছন্দ করবেন, মেন্যুতে ভর্তা-ভাজি থাকবে কি না। নাকি বাজার থেকে দেশি মুরগি এনে রোস্ট করবেন ? রাতে মিষ্টি জাতিয় কিছু না রাখলে অতিথির মন ভার হতে পারে, এমন প্রশ্নও কম জ্বালাতন করতো না।
ভোজন রসিক বাঙ্গালির পেট পূজো শেষে বড় চিন্তা ঘুম! দুপুরের খাবার শেষে যেখানে ভাতঘুমের দরকার; রাতের নিদ্রার আবশ্যকতা কতটা সেটা দুই বাক্যে লিখে শেষ করবার নয়। রাতে শোবার ঘরের বন্দোবস্ত না করতে পারলে ইজ্জ্বত মাটিতে লুটাবে! আলিশান বিছানার বন্দোবস্ত করতে না পারলেও সাধ্যের মধ্যে সেরাটা দিতে কৃপণতা করা যাবেনা। নিজেদের অবস্থা না হয় তথৈবচ হলো; মাত্র তো দু-চার দিনের ব্যাপার! দেখতে দেখতে কেটে যাবে। নিজেদের নিয়মিত বিছানা ছেড়ে দিয়ে মেঝেতেই শয্যাশায়ী অতিথি পরায়ণ বেচারা! কুটুম তবুও সুখের নিদ্রাযাপন করুক!
তবে আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় প্রেক্ষাপট অনেকটা ভিন্ন। অনেকটা বললে ভুল হবে; একেবারে মুদ্রার উল্টোপিঠ! বিশেষ করে রাজধানী ঢাকা। এখানে অতিথিকে আর ’নারায়ণ’ হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। আসলাম-বসলাম-চলে গেলাম টাইপের সম্পর্কের বেশ কদর। হবেই না কেন; ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মানুষ আজ বড্ড ব্যস্ত। অন্যকে নিয়ে মেতে থাকার সময় কোথায়?! কুটুম বাড়িতে তাই দীর্ঘ সময় না থাকার অঘোষিত বিজ্ঞাপন ঝুলতে দেখা যায়। প্রবেশ মুখে ”অতিথির গাড়ী বাইরে রাখুন” টাইপের বার্তাকে অঘোষিত বিজ্ঞাপন বললে ভুল হবেনা।
কুটুম বাড়িতে এসে নারায়ণের দুই চাকা কিংবা চার চাকার বাহনকে বাইরে রেখেই সময় কাটাতে হয়। ক্ষণিকের মিলনে বাহন বাইরে রাখাই শ্রেয় মনে করেন। অনেকটা অভ্যস্তও হয়ে উঠেছেন আধুনিক ঢাকার কুটুমেরা! দিনে এসে দিনে ফিরে যাওয়াকে ‘রীতি’ ধরেছেন কুটুমগণ। খাবার গলধ:করণ করেই ভো দৌড়! হোক না সেটা সকাল-দুপুর কিংবা রাত! গাড়ী বাইরে রেখে দিনের পর দিন অতিথিসেবা গ্রহণ করার অবকাশ নেই। নো পার্কিং জোনে গাড়ী রাখার শাস্তির কথাও ভুলে গেলে চলে না!
একসময় বাঙ্গালীর ইতিহাসে অতিথিশালা বলতে একটা ব্যাপার ছিল, আগামী প্রজন্মের কাছে সেটা বোধগম্য হবেনা। মোঘল আমলের ইতিহাস পড়ার মতো অতিথিশালা নিয়ে পড়াশুনা করতে খুব বেশি দেরি নেই। ইতিহাস সংরক্ষণে হেয়ালিপনা হলে বাংলা অভিধান থেকে আতশকাঁচ দিয়ে অতিথিশালা শব্দটি বের করতে হবে! বংশ পরম্পরায় চলে আসা রীতির এমন দূর্দশা হবে বছর কুঁড়ি আগেও হয়তো কেউ ভাবেননি।
শহরে প্রতিদিন আগন্তুকের সংখ্যা বাড়ছে। গাণিতিক হারে বাড়লে শঙ্কার মাত্রা কম থাকতো। কিন্তু সংখ্যাটা জ্যামিতিক বলে ভয়। মানুষের চাহিদার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আবাসন ভূমির দাম। কোটি টাকার প্লটে কেউ এক ইঞ্চি জায়গা ছাড়তে রাজি নয়। বেজমেন্টের সুবিশাল জায়গাকে কাজে লাগাচ্ছেন গ্যারেজ হিসেবে ভাড়া দিয়ে। চার চাকা বিশিষ্ট যানের বিশ্রামের জায়গাটি ভাড়া দিলে অর্থের সঞ্চার হচ্ছে। মাস গেলেই উপরি টাকা! কুটুমের সুবিধার্থে গাড়ীর স্থান রিজার্ভ রাখতে বয়েই গেছে!
অতিথি পরায়ণ ব্যক্তিরও হয়তো দুঃখের শেষ নেই। ভাড়া বাড়ি কিংবা অ্যাপার্টমেন্টে থেকে নিজেও যে ভুক্তভোগী! ফ্ল্যাট নামক সীমিত জায়গার ‘খুপরি’তে থেকে মাঝেমাঝে নিজেকেই একবেলার অতিথি মনে হয়! নিজের ব্যবহৃত গাড়ীর জন্যও গুনতে হয় আলাদা টাকা। অতিথি তো অনেক দূরের কথা। তাই ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় বলেন, ”অতিথির গাড়ী বাইরে পার্ক করুন”!