জাতীয়
অনন্তলোকে গানের পাখি

হৃদয় সাহা: ‘একটা ছিল সোনার কন্যা, মেঘ বরণ কেশ,ভাটি অঞ্চলে ছিল সেই কন্যার দেশ’। শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমায় শহুরে যুবক সুরুজ মিঞা গানে গানে বলেছিলেন সোনার কন্যা কুসুমের গল্প। হুমায়ূন আহমেদের কথায় দারুন জনপ্রিয় এই গানটি সুরুজ মিঞার হয়ে দরদমাখা কন্ঠে শ্রোতাদের কাছে যিনি পৌঁছিয়েছিলেন, সঙ্গে অর্জন করেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গায়ক ‘সুবীর নন্দী’। ‘যদি কেউ ধূপ জ্বেলে যায়, ঢাকা বেতার কেন্দ্রে রেকর্ডকৃত উনার প্রথম গান, এই গান প্রচারিত হয়েছিল ১৯৭০ সালে। এর আগে তিনি সিলেট বেতারে গান করতেন, সেখানে তিনি সাহচর্য পেয়েছিলেন বিদিত লাল দাশ ও বাবর আলী খানের। সেই থেকেই সঙ্গীত জীবনের পথচলা শুরু, একের পর এক দারুন গান গেয়েছেন তিনি, যার বেশিরভাগ ই পেয়েছিল শ্রোতাপ্রিয়তা।
‘দিন যায় কথা থাকে, সে যে কথা দিয়ে রাখলো না’, বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় গানের তালিকায় এই গান নিশ্চিতভাবেই প্রথমদিকে থাকবে। খান আতার ‘দিন যায় কথা থাকে’ সিনেমায় এই গান গেয়েই তিনি শ্রোতাপ্রিয়তা পেতে থাকেন, এই গানের জন্য বাচসাস ও পেয়েছিলেন। একই সিনেমায় ‘নেশার লাটিম ঝিম ধরেছে’র মত জনপ্রিয় গানটিও উনিই গেয়েছিলেন। বাংলা চলচ্চিত্রে প্রথম প্লেব্যাক করেন ‘সূর্যগ্রহণ’ সিনেমায়। কালজয়ী সিনেমা ‘অশিক্ষিত’ সিনেমার সেই বিখ্যাত গান ‘ ও মাস্টার সাব আমি দস্তখত শিখতে চাই’ উনার ই গাওয়া। লাল গোলাপ সিনেমায় ‘পাখিরে তুই দূরে থাকলে’ গানটির মত কালজয়ী গানটিও তিনি গেয়েছেন। উছিলা সিনেমায় ‘কত যে তোমাকে বেসেছি ভালো’র মত সাড়া জাগানো গান থেকে মাটির মানুষ সিনেমায় ‘বন্ধু হতে গিয়ে তোমার শত্রু বলে গণ্য হলাম’ গানটির ও গায়ক তিনি। ‘আমার এ দুটি চোখ পাথর তো নয়,তবু কেন ক্ষয়ে ক্ষয়ে যায়’,বাংলা সঙ্গীত জগতের অন্যতম সুন্দরতম গান। আলমগীর কবিরের ‘মহানায়ক’ সিনেমায় এই গানটি ব্যবহৃত হয়েছিল, সেই সুবাদেই অর্জন করেন প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
একই সিনেমাতেই ব্যবহৃত হয়েছিল উনার ই আরেক বিখ্যাত গান ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’। দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শুভদা সিনেমার ‘তুমি এমনই জাল পেতেছো সংসারে’ গান গেয়ে। হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন সিনেমায় ‘একটা ছিল সোনার কন্যা’ গানের সুবাদে তৃতীয় বারের মত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান, চন্দ্রকথা সিনেমায় ‘ও আমার উড়ালপঙখীরে,গরুর গাড়ির দুই চাক্কা’ গান ও বেশ জনপ্রিয়তা পায়,শ্যামল ছায়া সিনেমাতে গেয়েছিলেন বিখ্যাত লোক গান ‘সোহাগ চাঁদ বদনী তুমি নাচোতো দেখি’। হাজার বছর ধরে সিনেমায় জহির রায়হানের কথায় আশা ছিল মনে মনে কিংবা তুমি সুতোয় বেঁধেছো শাপলার ফুল গানেও তিনি মুগ্ধ করেছেন। সিনেমায় গানের জন্য মোট পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন,চতুর্থবার পান মেঘের পরে মেঘ সিনেমায় ‘ভালোবাসি সকালে’ গানের জন্য এবং সর্বশেষ পেয়েছেন মহুয়া সুন্দরী সিনেমায় ‘তোমারে ছাড়িতে’ গানের জন্য।
‘আমি বৃষ্টির কাছ থেকে কাঁদতে শিখেছি’,সিনেমার গানের বাইরে উনার গাওয়া অন্যতম সেরা গান। পাহাড়ের কান্না,সেই দুটি চোখ,চাঁদের ও কলঙ্ক আছে সহ বেশ কয়েকটি টিভি, বেতারে উনার বেশ জনপ্রিয় গান আছে। গায়কীর পাশাপাশি তিনি পেশায় ছিলেন ব্যাংকার। জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও নিজের সুনির্বাচনের দক্ষতার কারণে অহরহ গান তিনি করেন নি,যার কারনে উনার বেশিরভাগ গান ই শ্রুতিমধুর হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সালে নিজের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের অবদান স্বরুপ একুশে পদক পেয়েছিলেন। জীবনের মায়া কাটিয়ে আজ তিনি চলে গেলেন অদেখা ভুবনে। ওপারে ভালো থাকবেন গানের পাখি।