বিনোদনসিনেমা ও টেলিভিশনহোমপেজ স্লাইড ছবি
অস্তিত্ববাদ নাকি নিখাদ এক প্রতিশোধ?

আসিফুর রহমান: স্কিজোফ্রেনিয়া? পুনর্জন্ম? ডিসওসিভ ডিজঅর্ডার? অস্তিত্ববাদ নাকি নিখাদ এক প্রতিশোধের গল্প? প্রথমেই বড়সড় স্পয়লার এলার্ট। এই রিভিউতে ড্রাকুলা স্যার সিনেমার প্রত্যেকটি সম্ভাবনা নিয়ে কাঁটাছেড়া করা হবে। দেখে না থাকলে রিভিউ এড়িয়ে যান। ১৯৭২ সালের এক কুয়াশাভরা সকাল। পুলিশের ভ্যানে করে অমল সোমকে নিয়ে আসা হলো এক নির্জন জায়গায়। বলা হলো, তোকে ছেড়ে দিচ্ছি, পালা! তারপর মাত্র একটি বুলেট।
অমল সোম। বিপ্লবী তরুণ। প্রেমিকা মঞ্জুরী আর বিপ্লব এর মধ্যে সে বিপ্লবকেই বেঁছে নেয় নির্দ্বিধায়। মঞ্জরী। অমল সোমের প্রেমিকা। এক রাতের আধারে প্রেমিক অমল সোম যখন ক্লান্ত হয়ে আশ্রয় চায় তার কাছে, সে ফিরিয়ে দিতে পারে না। ২০২০ সাল। রক্তিম চৌধুরী নামক এক স্কুলমাস্টারের দুটি অতিরিক্ত লম্বা দাঁত আছে যেগুলোর কারণে তাকে সবাই ভয় পায়, বিশেষ করে বাচ্চারা। ড্রাকুলা স্যার নামটা তার সেখান থেকেই আসে..
দাঁত দুটির কারণে নাস্তানুবুদ রক্তিম চৌধুরী যখন আত্মহত্যা করতে যায়, তখন তাকে বাঁচায় মঞ্জরী, ১৯৭২ সালের মঞ্জরী ২০২০ সালে এসে ট্রেনের নিচে ঝাপ দেওয়া থেকে বাঁচায় রক্তিম চৌধুরীকে।
বিশদ আলোচনা: ১. রক্তিম চৌধুরী স্কিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলো। নিজের মতো করে হ্যালুসিনেট করে জগৎ সৃষ্টি করে বাস্তবজীবনকে অস্বীকার করা; স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণ।
২. ডিসওসিভ ডিজঅর্ডার যদিও স্কিজোফ্রেনিয়ার লক্ষণের মধ্যেই পড়ে তবু যেহেতু আলাদা করার মতো সুযোগ গল্পকার এবং চিত্রনাট্যকার ইচ্ছে করেই রেখেছেন, অতএব স্কিজোফ্রেনিয়াকে অস্বীকার করে এটাকে ডিসওসিভ ডিজঅর্ডারও বলা যেতে পারে। রক্তিম চৌধুরী তিনটি চরিত্র বয়ে চলেছেন সিনেমাজুড়ে। প্রথমটি নিজের, পরেরটা অমল বোসের এবং অন্যটা ড্রাকুলার।
৩. পুনর্জীবন হওয়ার সম্ভাবনা শুরুর দিকে দেখা দিলেও ধীরে ধীরেই সেটা মিলিয়ে যায়। এবং একদম শেষ দৃশ্যে সেই সম্ভাবনার সুতো পরিচালক কাঁচি দিয়ে একটানে কেটে দিয়েছেন।
৪. মঞ্জরীর প্রতিশোধ নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো। তার আত্মা হয়ে ফিরে আসার সম্ভাবনা বারবার উঁকি মারলেও কমার্শিয়াল সিনেমা না হওয়ায় সেই সম্ভাবনা হাওয়ায় মিলিয়ে যায় মুহুর্তেই।
আমি রক্তিম চৌধুরী। নকশালবাদ নিয়ে আমার পড়াশোনার আগ্রহ আছে। ঘরভর্তি বিপ্লবী বই আর আমার স্কুলের ঠিক সামনেই একজন কথিত বিপ্লবীর বেদি রয়েছে যাকে অমল বোস নামে সবাই চিনে। আমি বন্ধুহীন। এই বন্ধুহীন থাকার পেছনে অবদান আমার পাটিতে থাকা অতিরিক্ত দুটি দাঁতের। স্কুলের বাচ্চা থেকে শুরু করে বাড়িওয়ালা সবার ভৎর্সনা আর বেশকিছু বিপদ আমাকে কোনঠাসা করে ফেলে। আমার তখন প্রয়োজন হয় গল্পের। আমি তখন নিজেকে বাঁচাতে নিজের অজান্তেই জন্ম দেই বেশ কয়েকটি চরিত্রের। নকশালবাদ নিয়ে পড়াশোনা থাকার কারণে আমি জানি একজন সত্যিকার বিপ্লবীকে প্রেমিকা ছেড়ে কিভাবে স্লোগানকে জড়িয়ে ধরতে হয় এবং পরবর্তীতে পুলিশের কাছে ধরা পড়লে দাঁত উপড়ে ফেলা থেকে শুরু করে কিভাবে একজন বিপ্লবীর পরিসমাপ্তি হয়।
আমার জগতে মঞ্জরীর জন্ম হয় নিজেকে আত্মহত্যা থেকে বাঁচাতে গিয়ে মৃত্যুভয় থেকে। অতিরিক্ত দাঁতের সাইজের জন্য আমি বিশ্বাস করতে শুরু করি আমি অমল সোম। একজন বিপ্লবী। আমার পুণর্জন্ম হয়েছে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। বিপ্লবীদের দাঁত উপড়ে ফেলে নির্যাতন জানা থাকায় এবং অতিরিক্ত সাইজের দুটি দাঁত থাকার কারণে আমার ভেতরে এই চরিত্র খুব সহজেই নিজেকে তৈরী করে ফেলে। ধীরে ধীরে আমি আমার আশেপাশের প্রত্যেকটি শত্রুকে একটি করে চরিত্র দিতে থাকি। ১৯৭২ সালের নকশালবাদ আন্দোলনের সময়কার চরিত্র। শারিরীক অবয়ব এবং চারিত্রিক মিল মিলিয়ে জন্ম নেয় একজন বিশ্বাসঘাতক এবং তার সহযোগী। তাদের চরিত্রকে আমার নিজের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে আমি আশ্রয় নিই বাড়িওয়ালার স্ত্রীর উপর পঙ্গু স্বামীর পাশবিক নির্যাতন এবং পত্রিকায় ছাপা হওয়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মুর্তি ভাঙার মতো বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলোর। আমার সাথে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটি ঘটনাকেই আমি ধীরে ধীরে আমার জগতে তৈরী করে রাখা ১৯৭২ সালের গল্পে ঢুকাতে শুরু করি।
এভাবে চলতে চলতে একসময় আমি হোঁচট খাই। জানতে পারি আমার গল্পের নায়ক আসলে নায়ক নয়। মৃত্যু ঘটে একটি চরিত্রের। কিন্তু নিজের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার জন্য আমাকে মঞ্জরী চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। তারপর আমাকে ঢুকে যেতে হয় আরেকটি নতুন চরিত্রে. এই হচ্ছে মূলত ‘ড্রাকুলা স্যার’ এর গল্প। এটাকেই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বানিয়ে পরিচালক দেবালয় ভট্টাচার্য বেশ মুন্সিয়ানার পরিচয়ই দিয়েছেন। পাশাপাশি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অভিনয়, বিজিএম, সঙ্গীত, কালার গ্রেডিং সবকিছু মিলিয়ে একটি পার্ফেক্ট প্যাকেজই হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘ড্রাকুলা স্যার’।