বাক্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
একবিংশ শতাব্দীতেও যাদের আদিম জীবন

মঞ্জুর দেওয়ান: দিন যাচ্ছে আর মানুষ প্রযুক্তি হয়ে নির্ভর পড়ছে। আদিমকালের গুহায় বাস করা মানুষ এখন আধুনিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। একসময়ের প্রকৃতি নির্ভর মানুষ এখন শহরায়নে বিশ্বাসী। শুধু শহর-নগর বললে ভুল হবে। পৃথিবী বসবাসের অযোগ্য হবে ভেবে, এখন থেকেই তার বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। চাঁদ থেকে মঙ্গল চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিজ্ঞানের বদৌলতে মানুষ যেখানে এতো সফলতার দেখা পাচ্ছে; পৃথিবীর এমন কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে এর ছিটেফোঁটাও পৌঁছেনি! হাজার বছর আগের জীবন ধারাকে পুঁজি করে টিকে আছে।
মানব সভ্যতা সৃষ্টির শুরু থেকে বসবাসরত এই গোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে জেনে থাকি আমরা। পৃথিবীর ৪০টিরও বেশি দেশে এদের আনাগোনা রয়েছে। সবমিলিয়ে ৩০/৩৫ কোটি আদিবাসী হলেও কিছু আদিবাসী বিলুপ্ত প্রায়। আধুনিক পৃথিবীর যাতাকলে পরে পিষ্ট হচ্ছে। প্রযুক্তি আর যন্ত্রের ব্যবহার যাদের জীবনে কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। নগরায়ন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হুমকি জেনেও আমরা থেমে নেই। অথচ আদিবাসীদের জীবন ধারণে প্রকৃতির উল্লেখ করার মতো কোনো ক্ষতি হয়না। তারপরও আধুনিক পৃথিবীর কারণে হারিয়ে যাচ্ছে পরিবেশের শুভানুধ্যায়ী অনেক আদিবাসী গোষ্ঠী। বিলুপ্তপ্রায় এমন তিনটি আদিবাসী গোষ্ঠী সম্পর্কে জানবো এই আয়োজনে।
পিগমিঃ পৃথিবীতে যতো আদিবাসী গোষ্ঠী আছে তার মধ্যে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে খুব সম্ভবত পিগমি জাতি। ক্ষুদ্র এই জাতিগোষ্ঠীর বাস মধ্য আফ্রিকায়। পিগমি শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ থেকে। বাংলায় যার অর্থ দাঁড়ায় কনুই পর্যন্ত। গ্রিক ভাষায় সাধারণত ছোট কিছু বুঝাতে এই শব্দটি ব্যবহার করা হয়। আধুনিক পৃথিবীর মানুষ এদেরকে পিগমি হিসেবে জানলেও এরা পিগমি শব্দের মানে জানেনা! এই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের ‘বা’ নামে সম্বোধন করে। যার মানে মানুষ। শরীরের গঠনের কারণে বিশেষভাবে পরিচিত আফ্রিকার আদিমতম এই জনগোষ্ঠী। এদের উচ্চতা স্বাভাবিক মানুষের চেয়ে বেশ কম। এদের উচ্চতা সাড়ে চার ফুটের বেশি লক্ষ্য করা যায়নি। পাপুয়া নিউগিনির দূর্গম এলাকায় এদের বাস হলেও একসময় এরা ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ারও বাসিন্দা ছিলো। এরা ছিলো মূলত ফিলিপাইনের ‘ইয়েতা’ আদিবাসী। বঙ্গপোসাগরের অদূরে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জেও রয়েছে এদের অস্তিত্ব। তবে শিকারের অভাব বন নিধনের কারণে আফ্রিকাসহ সব জায়গা থেকেই এদের অস্তিত্ব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
শত বাধা আর প্রতিকূল পরিবেশ উপেক্ষা করে কঙ্গোর গভীর বনে এখনো রয়েছে পিগমি সম্প্রদায়ের বাস। এছাড়া ক্যামেরুন ও গ্যাবোনের জঙ্গলে পিগমিদের কয়েকটি উপজাতি বাস করে। পিগমিরা স্বভাবত খুবই নিরীহ। এরা অনেকটা যাযাবর প্রকৃতির। স্বল্প সময়ের জন্য বাসস্থান তৈরি করে থাকে। পিগমিরা দলগত শিকারে বিশ্বাস করে। চতুষ্পদ প্রাণী , বুনো ফল, মধু পিগমিদের খাদ্য তালিকার প্রথম স্থান দখল করে আছে। নিজেদের মধ্যে কখনো-ই ঝগড়ায় যায়না। হাসি-কান্না ভাগাভাগিতে বিভিন্ন ধরনের নাচের আয়োজন করে পিগমিরা। নাচের মাধ্যমে এদের মনের ভাব প্রকাশ করে। এছাড়া যেকোনো শিকারের আগে ও পরে পিগমিরা বৈচিত্র্যময় নৃত্য করে। ধারণা করা হয় মানব সভ্যতার প্রথম ধাপের বংশধর এই পিগমি জাতি। কিন্তু ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশের বনউজাড়কারীদের কারণে ব্যহত হচ্ছে পিগমিদের বিচরণক্ষেত্র। গোটা পৃথিবীতে বর্তমানে মাত্র ১ লাখ পিগমি টিকে আছে।
জারোয়া: ব্রিটিশ শাসনামলে বঙ্গোপসাগেরের আন্দামান দ্বীপ ছিলো অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতাকামীদের কারাগার। এছাড়া অন্যান্য অপরাধীদের ঠাই হতো এখানকার সেলুলার কারাগারে। ব্রিটিশামল শেষ হয়েছে দীর্ঘদিন হলো। এই অঞ্চলে এখন বাস জারোয়া আদিবাসীর। ভারতশাসিত আন্দামান ও নিকোবর নামক দুটি রাজ্যের দুর্গম এলাকায় বাস এদের। এই দ্বীপের বেশির ভাগ অংশ জনসবতিহীন। প্রতিকূল আবহাওয়া মোকাবিলা করে ওঙ্গি, গ্রেট আন্দামানিজসহ বেশ কয়েকটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের বসতি রয়েছে এখানে। আন্দামান দ্বীপে মাত্র চারশো’র কিছু অধিক মানুষের বাস রয়েছে। একসময় আফ্রিকা মহাদেশ থেকে এশিয়ায় পাড়ি জমাতো তখনকার বাসিন্দারা। ধারণা করা হয় আফ্রিকা থেকে এশিয়ায় আসা প্রথম সময়ের মানুষের বংশধর এই জারোয়া জাতি। দ্বীপের দক্ষিণ-পূর্বে বসবাস করা এই আদিবাসীদের জীবন ব্যবস্থা এখনো আদিমকালের মতো। অর্ধ নগ্ন আর বস্ত্রহীন হয়ে চলাফেরা করে এই সম্প্রদায়ের মানুষ। বন থেকে পাওয়া ফলমূল-জীবজন্তু আর সমুদ্রের মাছ শিকার করে এরা টিকে থাকে। আমাদের কথিত ‘সভ্য’ সমাজের মানুষদের প্রবেশাধিকার একেবারেই অপছন্দ এই জনগোষ্ঠীর। যে কারণে জারোয়া জনগোষ্ঠীর বসবাসরত এলাকায় বাইরের মানুষের প্রবেশ নিষেধ।