
কোভিড-১৯ পরিস্থিতি একাধারে আমাদের জনগণ, রাষ্ট্র ও স্বাস্থ্যসেবা প্রশাসন প্রত্যেকের জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। আগামী দিনের স্বাস্থ্য সেবায় এই পরিস্থিতি খুব একটা পরিবর্তিত হবে না। এই অভিজ্ঞতাকে সাথে নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে। কিন্তু এর জন্য কতটা প্রস্তুত আমরা? বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে কি হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে তা ধারনা করার আগে একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে।
বিশ্বস্বাস্থ্য (ডব্লিউএইচও) সংস্থা’র মহাপরিচালক তেড্রোস অ্যাডানাম গ্যাব্রিয়ুস যখন ১১ মার্চ করোনা ভাইরাসের সংক্রমণকে ‘বিশ্বব্যাপী মহামারী’ হিসেবে ঘোষণা করলেন তখনো আমাদের দেশে রোগটির বিস্তার ও বিপদ নিয়ে নীরবতা ছিল লক্ষ্যণীয়। বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের তরফ থেকে করোনা সংক্রমণের ব্যাপারে সতর্কতা এলো ১৭ মার্চ দিবাগত রাত থেকে। এর আগে ১৬ মার্চ থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার মাধ্যমে বোঝা যাচ্ছিলো দেরিতে হলেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় করোনা পরিস্থিতির গুরুত্ব আমলে নিতে যাচ্ছে। একই সাথে সংকুচিত করা হয় ‘মুজিব বর্ষ’ উপলক্ষ্যের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানগুলো।
এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ড: পুনম ক্ষেত্রপাল সিং সাবধান করে জানিয়েছিলেন, নতুন আগত করোনা ভাইরাসটির ব্যাপারে এই মুহূর্তে সবার জরুরী প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। কারণ, ইতিমধ্যে এই এলাকায় থাইল্যান্ড ও নেপালে করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। সেই লক্ষ্যে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা কোভিড-১৯ রোগের শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া, ল্যাব টেস্ট, রোগের চিকিৎসা, প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য নির্ধারিত গাইডলাইন মেনে এই অঞ্চলের দেশগুলোকে প্রস্তুতি নেবার পরামর্শ দেয়। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস নিয়ে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা ও সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ডিরেক্টর জেনারেল অব হেলথ সার্ভিস বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বরাতে জরুরী ভিত্তিতে এক সমন্বিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এই বছরের ১৩ই ফেব্রুয়ারি।
সভায় জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠনের প্রতিনিধিসহ বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী ছাড়াও জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের এনজিও সংগঠনের মোট ৪১ জন প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করেন। সেই জরুরী সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ এই মর্মে সভায় অবহিত করেন, অতি শীঘ্র তাঁর অধীনে সকল সিভিল সার্জনদের কোভিড-১৯ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে জরুরী গাইডলাইন পৌঁছে দেবেন। একই সাথে যদি আক্রান্ত দেশ থেকে কোন প্রবাসী দেশে ফিরেন, তবে তাকে আশকোনা হাজী ক্যাম্পে কোয়ারেন্টিন বা সঙ্গরোধ হিসেবে রাখার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। সেই সভায় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে আগত মূল প্রতিনিধি ডাঃ হাম্মান এল সাক্কা আরো অবহিত করেন, ঢাকা’য় অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব এপিডিমলজি ডিজিজ কন্ট্রোল রিসার্চ বা সংক্ষেপে আইইডিসিআর’কে কোভিড-১৯ রোগী শনাকরণের জন্য ল্যাবরেটরী সুবিধা ও এই সংক্রান্ত রিএজেন্ট সরবরাহ করবেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চাহিদা মোতাবেক। সেই সাথে বাংলাদেশের সাথে সকল প্রকার আন্তর্জাতিক বহির্গমনের পয়েন্টে সতর্কতামূলক নিরাপত্তা জোরদারের ইস্যুতে পরামর্শ দেন।
সভায় অন্যান্য দাতাগোষ্ঠীরা মত প্রদান করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পিপিই বা সুরক্ষা সরঞ্জাম জোগাড় করে দেবেন। তাছাড়াও করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য একযোগে কাজ করতে প্রস্তুত তারা। তথ্যগুলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া’র ওয়েবসাইট ঘাঁটলে যে কেউ পাবেন। অর্থাৎ, আমাদের সংশ্লিষ্টমহল ঠিকই ওয়াকিহবাল ছিলেন এই ভাইরাসটির আগ্রাসন সম্পর্কে। ২৭ জানুয়ারী বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার করোনা ভাইরাসের মহামারী হিসেবে জরুরী ঘোষণার জেরে সজাগ হয়ে ১২ই ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি জরুরী বিজ্ঞপ্তি জারি করে সকল বেসরকারী হাসপাতালসমূহের প্রতি। বিজ্ঞপ্তির বিষয় ছিল, ‘করোনা ভাইরাসজনিত জটিলতা মোকাবেলায় বেসরকারী ক্লিনিক, হাসপাতাল সমূহের করণীয়’ শীর্ষক নির্দেশাবলী। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করে দেয়া হয় বেসরকারী হাসপাতালগুলোর অনুমোদিত শয্যা সংখ্যার বিপরীতে কতটি আইসোলেশন ওয়ার্ড থাকতে হবে। দেখানো হয় সর্বনিম্ন ১৫ শয্যার হাসপাতালে আইসোলেশন ওয়ার্ডে ১ টি ও সর্বোচ্চ ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালে আইসোলেশন বেড হতে হবে ২০ টি। সেই ওয়ার্ড ব্যবস্থাপনার জন্য একই সাথে একটি গাইডলাইন দেয়া হয় উক্ত বিজ্ঞপ্তিতে।
কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞপ্তিটির কার্যকারিতা তথা উপযোগিতা বিশেষ করে গ্রামীণ বা প্রান্তিক এলাকার বেসরকারী হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোতে পরিপালন করা সম্ভব কিনা তা সরেজমিনে খতিয়ে দেখা হয় নি। কারণ হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারী হাসপাতাল ও অল্প কিছু প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালগুলো ছাড়া অন্যান্য ব্যক্তি মালিকাধীন পরিচালনায় হাসপাতালগুলোর ভৌত অবকাঠামো, পরিসেবার মান, পরিসর ও জনবলের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেই সাথে করোনা রোগের নির্দিষ্ট গাইডলাইন না থাকায় এই নতুন অজানা রোগের সংক্রমণ বিষয়ে তাত্ত্বিক ও হাতে-কলমে যথাযথ জ্ঞানের ঘাটতি থাকা স্বাভাবিক।