বাক্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
জওহরলাল নেহেরু ও এডুইনার ঐতিহাসিক প্রেম

আরিফুল আলম জুয়েল: নেভাল অফিসার, নাম তাঁর লুইস ‘ডিকি’ মাউন্টব্যাটেন! অবশ্য আরেকটি পরিচয়ও তাঁর ছিল, স্বয়ং রানী ভিক্টোরিয়ার বংশধর! ডিকি তৎকালীন সময়ে ‘ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দরী নারী’ হিসেবে বিবেচিত, এডুইনা অ্যাশলেকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন! ঘটনাটি উনবিংশ শতাব্দীর বিশ দশকের ঘটনা।
আসলে ডিকি তাঁর প্রেমের পরিণতির জন্যই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, এবং বিয়ে ও করেছিলেন তৎকালীন ইংল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দরী নারী, এডুইনা অ্যাশলেকে! যাই হোক, মাউন্টব্যাটেন দম্পতির জীবন চলে যাচ্ছে, নানান চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, তাঁদের দাম্পত্য জীবন যে খুব সুখের ছিল তা বলা যাবে না। অনেক ঘটনার কাল-পরিক্রমায় চলে আসলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ; শুরু হলো, এক সময় ঝড় থেমেও গেল! ফলশ্রুতিতে পুরো পৃথিবীর মানচিত্রই বদলে গেল! বছর দুই বাদে, ১৯৪৭ সালে ডিকি ভারতের ভাইসরয় নিযুক্ত হন এবং এডুইনাকে নিয়ে চলে আসেন ভারতের ভাইসরয় প্রাসাদে।
আর ঠিক এমন সময়েই, এডুইনার সাক্ষাৎ হয় তার স্বপ্নপুরুষের সাথে, যার দেখা পাবার জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করে গিয়েছেন তিনি, কাটিয়েছেন শত-সহস্র বিনীদ্র রজনী, পাননি একাধিক পুরুষের সান্নিধ্যেও চির-আকাঙ্ক্ষিত স্বাচ্ছন্দ্য ও স্বস্তি। সেই মানুষটি জওহরলাল নেহেরু।
আর পাঠক নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন- ডিকি আসলে কে, যিনি সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন নামে।ভারতে তখন চলছে সত্যিই বড় কঠিন সময়। ডিকি, যিনি সর্বমহলে পরিচিত ছিলেন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন নামে, তিনি তখন প্রচণ্ড ব্যস্ত কংগ্রেস আর মুসলিম লিগের মধ্যে সালিশিতে। ভারত কীভাবে স্বাধীন হবে, খণ্ড-বিখণ্ডিত হবে নাকি প্রবেশগুলো স্বরাজ-স্বায়ত্তশাসন পেয়ে যুক্তরাষ্ট্র গঠন করবে, এসব চিন্তায় তার রাতের ঘুম হারাম।
আর অন্যদিকে, ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ব্রিটিশরা যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দিয়েছিল, সেখানে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মধ্যে কিছু দপ্তর ভাগ করে দেয়া হয়েছিল। এর ফলে স্বরাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্ব পেয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেল এবং অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল মুসলিম লীগ নেতা লিয়াকত আলী খানকে। কিছুদিনের মধ্যেই কংগ্রেস নেতারা বুঝতে পারলেন, মুসলিম লীগের হাতে অর্থ দপ্তরের দায়িত্ব ছেড়ে দেয়া বিরাট ভুল হয়েছে। কারণ লিয়াকত আলী খানের অনুমোদন ছাড়া সরদার প্যাটেল একজন চাপরাশিও নিয়োগ করতে পারছিলেন না।
ফলে কংগ্রেস নেতাদের নেয়া সিদ্ধান্তু গুলো বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো। মৌলানা আজাদের বর্ণনা অনুযায়ী, কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেলের কারণেই এ পরিস্থিতির তৈরি হয়। কারণ সরদার প্যাটেল স্বরাষ্ট্র দপ্তর নিজ হাতে রেখে লিয়াকত আলী খানকে অর্থ দপ্তর দিয়েছিলেন। র্নিবাহী পরিষদের সদস্যদের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্যের সুযোগে লর্ড মাউন্ডব্যাটেন ধীরে ধীরে পূর্ণ ক্ষমতা নিজের কাছে নিয়ে নেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন বলেছিলেন, একমাত্র ভারত বিভক্ত হলে এর সমাধান হতে পারে।
আসলে লর্ড মাউন্টব্যাটেন উভয়পক্ষকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন এবং উভয়পক্ষকে বুঝিয়েছিলেন যে পাকিস্তানের সৃষ্টি না হয়ে উপায় নেই। মি: মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের মনে পাকিস্তান সৃষ্টির বীজ বপন করেছিলেন। আর ভারতীয় নেতাদের মধ্যে সরদার প্যাটেল মাউন্টব্যাটেনের এ ধারণা সবার আগে গ্রহণ করেছিলেন। আর ওদিকে এডুইনা তথা লেডি মাউন্টব্যাটেনের ঘুম হারাম জওহরের চিন্তায়। জওহরের সাথে এডুইনার প্রেমের শুরুটা হয়েছিল ম্যাশোবরা নামক পাহাড়ি স্টেশনে। সবাই মিলে ফ্যামিলি পার্টিতে গিয়েছিলেন তারা। সেখানেই, অনাত্মীয় জওহরের সাথে আত্মার সম্পর্ক তৈরি হয়ে গিয়েছিল এডুইনার। সম্পর্কের প্রাথমিক পর্যায়ে জওহরকে লেখা এক পত্রে মনের অর্গল খানিকটা খুলে দিয়েছিলেন এডুইনা। তিনি লিখেছিলেন,
“আজ সকালে যখন তুমি গাড়ি চালিয়ে চলে যাচ্ছিলে, তখন আমার খুব খারাপ লাগছিল। তবে তুমি চলে গেলেও, আমাকে রেখে গিয়েছ এক অদ্ভূত প্রশান্তিময় অনুভূতিতে… তোমার মনেও কি আমি একই অনুভূতি জাগাতে পেরেছি?”
এডুইনার প্রতি জওহরের ভালোবাসা এতটাই তীব্র ও সুগভীর ছিল যে, তিনি পৃথিবীর যেখানেই যেতেন সেখান থেকেই এক টুকরো ভালোবাসা কুড়িয়ে আনতেন প্রিয় মানুষটির জন্য। কখনো যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে আসতেন চিনি, মিশর থেকে সিগারেট, সিকিম থেকে ফার্ন। একবার উড়িষ্যা গিয়ে সূর্যদেবতার মন্দির থেকে কামোন্মত্ত ভাস্কর্যের ছবিও তুলে এনেছিলেন।তবে তাদের প্রেমে লুকোছাপা ছিল! এই লুকোছাপার নেপথ্যে কী কারণ থাকতে পারে, তা আজো রহস্যাবৃত। কেননা জওহরের সাথে এডুইনার সম্পর্কের ব্যাপারে যে গোড়া থেকেই সব জানতেন ব্রিটিশ ভারতের শেষ ভাইসরয়। এমনকি এতে তার প্রচ্ছন্ন আস্কারাও ছিল। কাছের মানুষদের কাছে সেই প্রশ্রয়তা প্রকাশেও তিনি ছিলেন দ্বিধাহীন,
“এডুইনা ভালো আছে। নেহেরুর সাথে ওর বনে ভালো। ওরা যখন একসাথে থাকে, তখন বড় সুখে থাকে। ভালো থাকুক ওরা।”
তাহলে এভাবেই কি লর্ড মাউন্ডব্যাটেন তার স্ত্রীকে দিয়ে ভারতকে ভাঙতে জওহরলাল নেহেরুকে রাজী করিয়েছিলেন! হতে পারে, ইতিহাস তো শুধু হিন্দু-মুসলমানে না, এদিকটাতেও ছিল! কথিত আছে, ভারতকে টুকরো টুকরো করে দিয়ে মাউন্টব্যাটেনরা যখন ব্রিটেনের উদ্দেশে রওনা হচ্ছিলেন, তার আগে এডুইনা চেয়েছিলেন জওহরকে একটি অত্যন্ত দামি হীরার আংটি উপহার দিয়ে যেতে। কিন্তু জওহর অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন সেই আংটি গ্রহণে। তাই এডুইনা আংটিটি তুলে দিয়েছিলেন জওহরের কন্যা ইন্দিরা গান্ধীর হাতে। বলেছিলেন, কখনো আর্থিক সঙ্কটের সম্মুখীন হলে সে যেন আংটিটিকে কাজে লাগায়। ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার পরও জওহরের সাথে চিঠি মারফত যোগাযোগ অব্যাহত ছিল এডুইনার।পরস্পরের সাথে অসংখ্য চিঠি আদান-প্রদান করেছিলেন তারা।
৫৯ বছর বয়সে যখন আকস্মিকভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান এডুইনা, ঠিক তার শিয়রের পাশেই রাখা ছিল এক ট্রাঙ্কভর্তি চিঠি। নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না, চিঠিগুলো কার! এডুইনার ইচ্ছে ছিল, তার শেষ ঠিকানা যেন হয় সাগরের বুকে।
তার সেই ইচ্ছা পূরণ করা হয়েছিল। এদিকে প্রিয়তমার মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নৌবাহিনীর জাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সেখানে, যেখানে সমাহিত করা হয়েছিল এডুইনাকে। নৌবাহিনী জওহরের পক্ষ থেকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেছিল এডুইনার সলিল সমাধিতে। পরবর্তীতে এডুইনার স্মরণসভায় হাজিরও হয়েছিলেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু।
কিন্তু, বাস্তবিকই ভারতবর্ষের মানুষ এডুইনার বিদায়ে শোকসন্তপ্ত হয়েছিল কি না, তা যেমন প্রশ্নসাপেক্ষ, তেমনই সন্দেহের অবকাশ রয়েছে জওহর-এডুইনার এই প্রেমকাহিনীর নির্মলতা প্রসঙ্গেও। মানুষের কাছে অনেক প্রশ্ন- আসলেই কি জওহর আর এডুইনার মধ্যে প্রেম ছিল, থাকলে তার গভীরতা ঠিক কতটুকু ছিল? কিংবা যে জওহরলাল নেহেরু ভারতকে ভাঙতে রাজী ছিল না, সে কেন শেষ পর্যন্ত ভারতকে ভাঙতে রাজী হল? তাহলে কি এর জন্য দায়ী এডুইনা, লেডি মাউন্ডব্যাটেন!
অনেকেরই ধারণা, তাদের দুজনের প্রেম কেবল তাদের দুজনাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং প্রভাবিত করেছিল গোটা ভারতবর্ষকেই। তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি মাওলানা আজাদের যেমন দৃঢ় বিশ্বাস, ভারত ভাগ করার ব্যাপারে জওহরকে রাজি করানোয় মুখ্যতম ভূমিকা পালন করেছিলেন এডুইনা। স্বামীর চিন্তা-ভাবনা তিনি ভাগ করে নিয়েছিলেন জওহরের সাথে, এবং জওহরের উপর স্বীয় প্রভাব খাটিয়ে তার সম্মতিও আদায় করে নিয়েছিলেন। ভাবুন- অনেকেই মনে করেন এই এক জওহরলাল নেহেরু-এডুইনা’র প্রেমের কারনে ১০ লক্ষাধিক ভারতবাসীর মৃত্যু হয়েছিল! শুধু তাই নয়- ১ কোটি ৪০ লক্ষ হিন্দু, শিখ ও মুসলমান ভারত বিভাজনের ফলে বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন এবং এর ফলে মানব ইতিহাসের বৃহত্তম দেশত্যাগের ঘটনাটি ঘটেছিল।