বিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
বাংলা রক ইতিহাসে একটি অভিনব জনরা’র নাম ‘জেমস’

ইশতিয়াক ইসলাম খান: ‘১৯৮১ সালে বব মার্লে দেহত্যাগ করলেন জ্যামাইকায়, কাকতালীয়ভাবে একই বছর পৃথিবীর আরেক প্রান্ত বাংলাদেশে ‘ফিলিংস’ ব্যান্ডে বাজাতে শুরু করলেন ফারুক মাহফুজ আনাম। অনেকেই হয়ত জানেন, আইয়ূব বাচ্চুও সংগীত জীবনের প্রথমদিকে এই ব্যান্ডে বাজাতেন, তখন ভোকালিস্ট ছিলেন রুডি থমাস। মং রাজার তিন ছেলে মংগু, গুলু ও রুডির প্রতিষ্ঠিত ‘ফিলিংস’ ব্যান্ড ইংরেজি গান করতেন বেশি, তবে মাঝে মাঝে বাংলা বা হিন্দি গাইতেন আরেক ভোকালিস্ট কুমার বিশ্বজিৎ। বাচ্চু ভাই ‘সোলস’-এ যোগ দিলেন আর রুডি কানাডা চলে গেলেন- ফলে সাময়িক অচলাবস্থা দেখা দেয়। নতুন করে কিছুদিন বাদে পাবলো আবার ব্যান্ড শুরু করার চেষ্টা করেন জেমসকে গিটারিস্ট হিসেবে সঙ্গে নিয়ে।জেমসের তখন ধ্যান জ্ঞান বলতে মার্ক নফলার, পুরো পৃথিবীই তখন কাঁপছে ‘ডায়ার স্ট্রেটস’ জোয়ারে। জেমস ভাই নিজেই বলেন, ডায়ার স্ট্রেটসের প্রতিটি গান নোট টু নোট বাজানোই ছিল সে সময়টায় তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য। প্রথমে গিটারিস্ট, পরে গিটারিস্ট কাম মূল ভোকালিস্ট হিসেবে ‘ফিলিংস’ এর দায়িত্ব কাঁধে নেন জেমস।
বাবা চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন, আর তার বাউন্ডুলে সন্তান তখন নিয়মিত পরীক্ষায় গোল্লা মারা আর ছয় তারে টোকা মেরে ‘সালতান অফ সুইং’ হতে ব্যস্ত। ফলাফল যা হবার তা-ই হয়েছিল, ক্লাস এইটে থাকা অবস্থায় বখাটে সন্তানের গৃহত্যাগ। স্যারদের মুখে শুনেছি, জেমস ভাই ‘৮৫ পরবর্তী সময়ে আমাদের মেডিক্যালেই প্রায় প্রতি সপ্তাহে ইংরেজি গান বাজাতেন। ফলে তুমুলভাবে ইংরেজি গান, নির্দিষ্ট করে বললে নফলারের প্রভাব ফিলিংস বা জেমসের প্রথম দু’টি এলবাম ‘অনন্যা’ ও ‘স্টেশান রোডে’ প্রবল ছিলো, এমনকি তাঁর সংগীতায়োজনে একমাত্র মিক্সড এলবামে হুবহু কপি সুরও আছে একাধিক। ‘৮৭ সনে ‘ফিলিংস’ এর ব্যানারে সেল্ফ টাইটেল্ড এলবাম দিয়ে যাত্রা শুরু (পরবর্তীতে এলবামের নাম পরিবর্তন করে ‘স্টেশান রোড’ রাখা হয়), ফ্লপ এই এলবামের পর আসে সেমিহিট একক ‘অনন্যা’।
এই সংশয়ী চেষ্টাগুলো থেকে বেরিয়ে জেমসের স্বকীয়তা প্রথম ঝিলিক দেয় ‘৯২ সালের ‘জেল থেকে বলছি’ এলবামে, আর ‘জেমসিজম’ পরিপক্ব রূপ নেয় তার দু’বছর পরের ‘পালাবে কোথায়’ শীর্ষক ফিতায়। তবে জেমসের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার গল্প শুরু ‘দু:খিনী দুঃখ কোরো না’ নামের একক এলবাম দিয়ে। জেমসের আসল স্বাদ পেতে হলে ‘নগর বাউল’, ‘দু:খিনী’ ও ‘লেইস ফিতা লেইস’ -এই তিনটি সিরিয়ালি প্রকাশিত এলবাম সমান গুরুত্বে আলোচনীয়, অবশ্যপাঠ্য ও ফরযে আইন। তবে ‘লেইস ফিতা লেইস’ এর পর ‘ফিলিংস’ এর নাম হয়ে যায় ‘নগর বাউল’, নাম ছাড়া বাকি সব যদিও একই রয়ে যায়।
জেমস প্রথম থেকেই নির্দিষ্ট ও নিজস্ব গন্ডিতে আলোচিত ছিলেন, তবে যতটা না স্বকীয় সংগীত মারফত, তার চেয়ে বেশি নফলার স্টাইল গিটারিং ও কাভারের খাতিরে। প্রথম দুটি এলবামে পথ খুঁজে ফেরার পর জেমস সেই যে গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়ালেন, এরপর ক্লিন-শার্প-এডজ নোট পাল্টে গেল ডিস্টোর্টেড, এলোমেলো, ক্যাওয়াজের ঝনঝনানিতে; সেমিডিসটিউন্ড এভারেজ গলা এক লাফে উঠে এলো দরাজ-উদাত্ত-সিগনেচার ভোকাল ওয়ার্কের শেলফে। জেমস জানান দিলেন, ইতিহাসের মোড় ঘুরে যাবে খুব শীঘ্রই।
বঙ্গদেশে ক্রমাগত মার খেতে থাকা সমাজের কাছে তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন তিনি। বিশেষ করে শূরাবিহীন আর্তনাদের অক্ষম জীবন কাটানো তারুণ্যের কাছে তিনি সাক্ষাত জেসাস হয়ে এসেছিলেন। বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে কেউ ‘আমিই সেই শেষ শারাবি’ গাইতে পারে, এই এক দৃশ্যই নাড়িয়ে দিতে চায় সামাজিক ট্যাবুর সাঁকো; ‘এসো চুল খুলে পথে নামি’ ডাকে প্রথাভাঙার স্বপ্ন দেখা প্রতিটি তরুণ উল্লসিত জোছনা দেখার মিছিলে লাইন দিয়ে পা বাড়াতে চায়। দু:খের রাত্রি পোহানো অন্ধকারে এক গ্লাস জোছনা হাতে একটা যুগ যেন তার মধ্যরাতের ডাকপিয়ন হতে চেয়েছিল।
‘৬৪ সালে নওগাঁয় জন্ম ফারুক মাহফুজ আনামের, আজ ২০১৯’তে এসে চট্টলা পেরিয়ে নওগাঁর নাম হারিয়ে তাঁর জন্মস্থান হয়ে দাঁড়িয়েছে দুঃখিনী বাংলাদেশ, পিতৃপ্রদত্ত নাম বিস্মরণে ঠাঁই নিয়েছে জেমসে। পঁচাশির প্রথম কনসার্ট থেকে ধরলেও এই ৩০ বছরের ভ্রমণকালে জেমসের দু’বার অন্তত খোলস পাল্টেছে, আমরা দেখেছি তিনটে জেমস। এক জেমস ‘অনন্যা’-র গন্তব্যের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ‘স্টেশান রোড’ খুঁজতে থাকা মফস্বলী, পরের জেমস নীলাভ বেদনার ভরাট আকুতিতে আর্তনাদ করে যুবাদের দিয়ে যা ইচ্ছে তা করানোর ক্ষমতাশালী ‘লেইস ফিতা লেইস’ এর সাদা পাঞ্জাবি-লাল গামছার সারথি, আর সর্বশেষজন ভূবন জয়ের অভিযানে নামা ‘আন্তর্জাতিক’/’কর্পোরেট পরিশীলিত’ কালো সিল্কের পাঞ্জাবিওলা জেমস।
‘জেল থেকে বলছি’ এলবাম দিয়ে অনেক বেশি বিস্তৃত শ্রেণীর শ্রোতা দখলপূর্বক জাত-পাত নির্বিশেষে তরুণদের মাঝে হাহাকার তুলে দেন জেমস। লতিফুল ইসলাম শিবলী স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন আর ছাত্র রাজনীতির তুখোড় উত্তাল দিনগুলোতে জেলযাপনের স্মৃতি নিয়ে লিখে সুর করেছিলেন ‘শোনো জেল থেকে আমি বলছি’ নামক মহাকাব্য। ঐ গান জেমস শিবলীর কাছে চেয়ে নিলেন, গাইলেন তাঁর দরাজ গলায় আর এক অসামান্য বিপ্লবী মায়ায় বাঁধা পরে গেল একটা প্রজন্মের প্রায় প্রতিটি তরুণ।
যে কথা না বললেই নয়, নফলারের ফিঙ্গার স্টাইল ঝনঝনানি বা মার্লের চুল দিয়ে জেমসের বিচার হয় না। ওগুলো ইন্সপিরেশন নি:সন্দেহে, ব্লটিং পেপারের মত জেমস এদের শুষেছেন জীবনভর। কিন্তু লালন আর বাউলফকিরের দেশে থেকে পূর্ব ও পশ্চিমা সঙ্গমে যা বেরিয়েছে, তা অভূত ও অশ্রুতপূর্ব। কারুকাজ দিয়ে অষ্টপ্রহর শেকলবন্দী রাখার তাড়নায় যে প্রথাভাঙা নতুনত্বের বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল বাংলা ব্যান্ডের বেসিক গানে, তাতে খোলা গলা আর চুলের ঝাঁকি দিয়ে উদাত্ত বক্ষচেরা আওয়াজ ও উদ্যত তর্জনীতে সবুজ আগুণ জ্বেলে দিয়েছিলেন এই লোকটা। ঐ গানের কোনো জনরা হয় না, ‘জেমস’ বাংলা রক ইতিহাসে একটি অভিনব জনরা’র নাম। ঐ জনরা ওভারড্রাইভে তীক্ষ্ম ক্যাঁচক্যাঁচানি নয়েজ, সেমিডিসটিউন্ড হেঁড়ে অথচ দরাজ গলার আর্তনাদ, টিপিক্যাল আট বা ষোলমাত্রার ফ্রেম ভেঙে হৃদয়ের মত বেতালা-বেহায়া কম্পোজিশান, মুখ ঢেকে যাওয়া চুলে সাদা পাঞ্জাবির আবছায়া কায়া আর সম্মিলিত এক জোয়ার জাগানিয়া এনার্কির মিশ্রণ।
জেমস একা একাই ‘নগরবাউল’ বা ‘গুরু’ হয়ে ওঠেননি, অনেকগুলো মানুষের অল্প বা বৃহৎ এফোর্ট ও আত্মত্যাগের গল্প অন্য প্রত্যেক সফল কাহিনীর মত এখানেও জ্বলজ্বলে। এহসান এলাহী ফান্টি, আওরঙ্গজেব বাবু, বুলবুল বা পাবলো’রা জেমসের মেরুদন্ডের একেকটা কশেরুকা, এরা স্টেজের আঁধারে নিজেদের মুড়িয়ে যেতে দিয়েছিলেন বলেই জেমসের ওপর ঐ স্পটলাইটের আলোটা তীর্যকভাবে স্পষ্টতর হতে পেরেছিলো আর আমরা একনিষ্ঠ মনোযোগে অল্প অল্প করে খুঁড়ে বের করতে পেরেছিলাম নাগরিক গিটারিস্টের ভেতর ঘাপটি মেরে থাকা এই বাউলটাকে।