জাতীয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস, বির্তক এবং অন্যান্য

মাহমুদুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের গৌরবের অংশ। এই প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষা লাভ করে দেশে বিদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন অনেক কৃতী মানুষ। বাংলাদেশকে তাঁরা তুলে ধরেছেন পৃথিবীর সামনে। আবার নানা কারণে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নানা সমালোচনার মুখে পড়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯৮ তম জন্মদিনে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনা ও অন্যান্য কিছু বিষয় জানবো।
ব্রিটিশ শাসনে নানা কারণে পূর্ববঙ্গ পিছিয়ে ছিল। শিক্ষা, চাকরী, সাংস্কৃতিক অংশগ্রহনে পূর্ব বাংলার অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল খুব কম। সে সময়ে কলকাতার মানুষেরাই ছিল শিক্ষা দিক্ষা এবং অন্যান্য বিষয়ে অগ্রগামী। ব্রিটিশদের সময়ের ইতিহাস দেখলে আমরা দেখতে পাবো সব ক্ষেত্রে কলকাতার শিক্ষিত সমাজের ভূমিকা।
এমতাবস্থায় ঢাকার নবাব পরিবার বিষয়টি নিয়ে ভাবিত হয়েছিলেন। তাঁরা ঢাকা এবং পূর্ব বাংলার জন্য কিছু করার চিন্তা করছিলেন। এমন সময় বঙ্গভঙ্গ হয়। অর্থাৎ পূর্ববঙ্গ তখন আলাদা প্রদেশ হয়ে গেলো এবং ঢাকা হলো রাজধানী। এ অবস্থায় ঢাকা এবং পূর্ব বঙ্গের নানা সুবিধা পাওয়ার কথা। প্রশাসনিক, শিক্ষা সব ক্ষেত্রেই। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের কারণে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হয়। বঙ্গভঙ্গ রদের ‘ক্ষতিপূরণ’ হিসেবে পূর্ববঙ্গকে কিছু সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর মধ্যে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথাও ছিল। সেটিই আজকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুনতাসির মামুন তাঁর ‘ঢাকাঃ স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী’ বইয়ে লেখেন,
“বঙ্গভঙ্গ রদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। লর্ড লিটন যাকে বলেছিলেন স্পেল্নডিড ইম্পিরিয়াল কমপেনসেশন পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি সব ক্ষেত্রেই পিছিয়ে ছিল। বঙ্গভঙ্গ হওয়ার পর এ অবস্থার খানিকটা পরিবর্তন হয়েছিল, বিশেষ করে শিক্ষার ক্ষেত্রে”।
বিশ্ববিদ্যালয়টি ঠিক কোথায় স্থাপিত হবে, অর্থাৎ কোথায় ‘ক্যাম্পাস’ হবে তা নিয়ে কিছু বিতর্ক ছিল। অতঃপর ঢাকার আজকের প্রাণকেন্দ্র শাহবাগ এলাকায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও অনেকেরই মোট ছিল শহর থেকে বাইরে হোক, কিন্তু তখনও যেহেতু আজকের মতো ব্যস্ত ঢাকা ছিল না, তাই শাহবাগেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়।
নবাব পরিবারের চেষ্টায় যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, এমন বিতর্ক ইদানীং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে খুব জনপ্রিয়। এমনিতেই দেশে প্রচুর রবীন্দ্র বিরোধী আছেন, তাদের কল্যাণে এটি আরও ফুলে ফেঁপে ওঠে। মূলত রবীন্দ্রনাথ আসলেই কিছু কথা বলেছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপরীতে। কিন্তু গভীর ভাবে ভেবে দেখলে, বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে রবীন্দ্রনাথের এই বিরধিতার মূলত ছিল তাড়াহুড়ো করে একটা প্রতিষ্ঠান শুরু করার বিরুদ্ধে। আরও সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে কাজটা করার কথা তিনি বলেছিলেন।
এমনকি আজও নানা বিতর্ক আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস নিয়ে। কিন্তু সে সব বাদ দিয়ে যদি আমরা এর ভালো দিকে তাকাই তাহলে দেখবো বিশ্ববিদ্যালয়টি আমাদের দিয়েছে অনেক কিছু। ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ নামে পরিচিত এ প্রতিষ্ঠানটিতে তিরিশ থেকে পঞ্চাশের দশকে যে সব শিক্ষক ছিলেন, তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞা, যোগ্যতার সাথে কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনা হতো না। সত্যেন বোস, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ল্যাংলি, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এফ রহমানদের মতো শিক্ষক পেয়েছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়।
পরবর্তী সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকদের কাছ থেকে দেশ কম কিছু পায়নি। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, গণ অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সব ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে অগ্রণী ভূমিকা। এমনকি স্বৈরাচার পতনের সময়েও তারা ছিল উদ্যমী।
সময়ের সাথে সাথে বদলে যায় অনেক কিছু। নানা কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম খুন্ন হলেও মনে রাখতে হবে আজও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের উচ্চশিক্ষার প্রধানতম প্রতিষ্ঠান। এর গৌরব আমাদেরই গৌরব। নানা বিষয়, অনুষদ এবং মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে পথে চলা দেশের সুপ্রাচীন এই বিদ্যাপীঠের জন্মদিনে তাই বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার শিক্ষক-ছাত্রদের অভিনন্দন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাক সুনামের সাথে।