চলতি হাওয়াজাতীয়হোমপেজ স্লাইড ছবি
পরবাস, মাতৃভূমি এবং অন্যান্য

রাফিউজ্জামান সিফাত: The Terminal মুভিতে Fear নামক খুব অসাধারণ একটি দৃশ্য আছে, ভিক্টর নাভরস্কি (টম হ্যাংকস) ইউরোপের ক্ষুদ্র একটি দেশ থেকে নিউইয়র্কের কেনেডি এয়ারপোর্টে এসে আটকে পড়ে কারন আচমকা ভিক্টরের দেশে যুদ্ধ শুরু হয় এবং ভিক্টরের পাসপোর্ট বাতিল হয়ে যায়। ফলে সে না পারে নিজ দেশে ফিরে যেতে না পারে নিউইয়র্কে প্রবেশ করতে, ফলে মাসের পর মাস সে এয়ারপোর্টে আটকে পড়ে। এয়ারপোর্টেই গোসল করে, খায়, কাজ করে, ঘুমায়।
এয়ারপোর্টের কর্মকর্তারা ভিক্টরকে এসাইলেমের সুযোগে আমেরিকান নাগরিকত্বের সুবিধা দিয়ে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আলাদীনের চেরাগ সমতুল্য সুযোগ করে দেয়।
ইনভেস্টিগেশন রুমে ভিক্টরের কাছে মাত্র একটি প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়, ‘তুমি কি এ মুহুর্তে তোমার দেশে ফিরে যেতে ভয় পাচ্ছ?’ উত্তরে ইয়েস বললেই ভিক্টর আমেরিকায় প্রবেশ করতে পারবে। কিন্তু ভিক্টর প্রশ্নের উত্তরে বলে ‘নো’
ইনভেস্টিগেটর আবার বুঝায়, ভিক্টরের দেশে যুদ্ধ চলছে, খুন হচ্ছে, কোন মানবিক অধিকার নেই, ভিক্টর তাই নিজ দেশে ফিরে যেতে তাই ভয় পাচ্ছে, ইয়েস বললেই এসাইলেম কিন্তু ভিক্টর আবারো নিঃসঙ্কোচে সেই কালজয়ী বাক্য উচ্চারণ করে বলে, ‘It’s home, I am not afraid of my home’
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত চীনের ইউহান প্রদেশ থেকে তিনশো ষোলজন বাংলাদেশী ছাত্র ছাত্রীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
উচ্চ শিক্ষা নিতে আমরা যারা বিদেশ যেতে চাই, আমাদের অধিকাংশের ইচ্ছা থাকে সেই দেশেই বাকি জীবনটা সেকেন্ড সিটিজেনশিপে থেকে যাওয়ার। কয়েকজন ব্যতিক্রম হতে পারে কিন্তু বুকে হাত দিয়ে যদি নিজেকে প্রশ্ন করেন উত্তর হবে, পড়াশুনা শেষে অইখানেই জব তারপর বহু সাধের পিআর।
প্রবাসে অবস্থানকারী প্রতিটা প্রাণ লাল সবুজকে বুকে লালন করে, প্রচন্ড ভালোবাসে, হয়তো বাইরে গেলে দেশের প্রতি টানটা একটু বেশীই টের পাওয়া যায় কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কেউই আর দেশে ফিরে আসতে চায় না।
মাঝে অবশ্য দেশে আসা হয়, বিয়ে করতে, মাস ছয়েকের ভিতরে স্পাউস ভিসায় বউসহ আবার বিদেশ যাত্রা। এরপর পাঁচ ছয় বছরে হয়তোবা একবার আত্মীয়য়ের বিয়েতে, জমি সংক্রান্ত দলিলে স্বাক্ষর করতে কিংবা বাবা মা’র জানাযার নামাযে দিন সাতেকের জন্য ফেরা, আবার উড়াল। বাদবাকি জীবনটা পরবাসেই ওয়েলসেটেল্ড।
উন্নত ভবিষ্যতের এ আকাঙ্ক্ষা মোটেও অমুলক নয়, হাজারো সমস্যায় জর্জরিত, হত্যা, গুম, সন্ত্রাস, মেধার অবমূল্যায়ন, দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিম্নজ্জিত এ দেশ নিয়ে বড় গলায় গর্ব করার সুযোগ দিন দিন সংকুচিত হয়ে আসছে। বাইরে সেটেলমেন্টের ইচ্ছাটা তাই খুবই যুক্তিসংগত।
বিদেশের মাটিতে নতুন পাসপোর্ট হয় তখন পরিচয়। সবুজ পাসপোর্টটা হয়তো কাপড়ের ড্রয়ারের এক কোনে পড়ে থাকে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বেড়ে উঠে প্রবাসের বিশুদ্ধ বাতাস, উন্নত শিক্ষা, আধুনিক সংস্কৃতিতে। ওদের মুখে বাংলা উচ্চারণ না করাটাই ফ্যাশন, বৈশ্বিক ডিম্যান্ড।
কিন্তু যখন মহামারী কোন দুর্যোগে অত্যাধুনিক সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র নাজেহাল, বিশ্বের কোন রাষ্ট্রই তাকে আশ্রয় দিতে চায় না,
তখন বিনা দ্বিধায় মস্তবড় ঝুঁকিতেও এ গরীব দরিদ্র দেশ তার নাগরিকদের ফিরিয়ে নিয়ে আসে,প্রচন্ড ঝড়ের রাতে ভয়ার্ত সন্তানকে যেভাবে মা পরম মমতায় বুকের ও’মে কাছে টেনে নেয়। দুর্যোগ শেষে আবার চলে যাবে জেনেও সেই কাছে টানায় কোন খুঁত থাকে না। এইটাই মাতৃভূমি, নাড়ির বাঁধন।