জাতীয়হোমপেজ স্লাইড ছবি
পৃথিবীর প্রাচীন ১০টি ভাষা

সাকিব রহমান সিদ্দিকী: ভাষা বিবর্তিত হয়। কখনো পুরো ভাষাই বদলে যায়, কখনো যুগের পর যুগ আস্তে আস্তে অন্য ভাষার সাথে মিশে যায়। একটি ভাষা কিভাবে আরেকটি ভাষায় রূপান্তরিত হয়ে যাবে তার পেছনে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই। এমনকি কোন ভাষা আরেকটি ভাষা থেকে প্রাচীন সেটিও বলা কঠিন। মানুষ এর জন্ম এবং ভাষার জন্ম একই সাথেই হয়েছে। বলা হয়ে থাকে প্রত্যেক ভাষারই কিছু না কিছু বিশেষ প্রাচীন বৈশিষ্ট্য আছে যা সেই ভাষা কে অন্য ভাষা থেকে আলাদা করেছে। এবার আমরা আলোচনা করবো পৃথিবীর প্রাচীন ১০ টি ভাষা নিয়ে।
হিব্রু
আনুমানিক ৪০০ খ্রিষ্টাব্দ হতে পবিত্র ভাষা হিসেবে সংরক্ষিত এই ভাষা উনিশ বিশ শতকে জায়নিজমের উত্থানের সাথে আবার ফিরে আসে। ভাষাটির পুনরুদ্ধারের পর ইসরায়েলের দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। যদিও বাইবেলের হিব্রুর সাথে ইসরায়েলী হিব্রুর বেশ পার্থক্য রয়েছে, তারপরেও ভাষাভাষীগণ বেশ স্পষ্টই দ্য ওল্ড টেস্টামেন পড়তে পারে এবং বুঝতে পারে। আধুনিক হিব্রু অন্যান্য ইহুদী ভাষা দ্বারা প্রভাবিত।
বাস্ক
রহস্যময় এই ভাষাটি স্পেন আর ফ্রান্সে বসবাসরত বাস্ক জনগোষ্ঠীর ভাষা। মজার ব্যাপার হল, এই অঞ্চলের প্রধান দুই রোমানীয় ভাষা, ফ্রেঞ্চ ও স্প্যানিশের কোন প্রভাব এই ভাষাতে নেই। এমনকি পৃথিবীর অন্য কোনো ভাষার সাথেই কোন মিল নেই। ভাষাবিদদের গবেষণাও এ ব্যাপারে কোনো উত্তর দিতে পারে নি। তবে এটুকু স্পষ্ট যে, এই ভাষাটির উৎপত্তি রোমানীয় ভাষার আগে, ল্যাটিন ভাষার সাথে, যে ভাষা থেকে স্প্যানিশ এবং ফ্রেঞ্চ ভাষার উৎপত্তি হয়েছে।
তামিল
৭৮ মিলিয়ন লোকের ভাষা তামিল। এই ভাষা শ্রীলংকা, সিংগাপুর এবং ভারতের দাপ্তরিক ভাষা। এটি আধুনিক পৃথিবীর মাঝে টিকে থাকা একমাত্র ধ্রুপদী ভাষাও বটে। গবেষকগণ খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ শতকেও এই ভাষা ব্যাবহৃত হওয়ার প্রমাণ পেয়েছেন। সংস্কৃত ভাষা ৬০০ খ্রিষ্টপূর্ব অব্দ হতে পবিত্র ভাষা হিসেবে জনমানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেলেও তামিল ভাষা দিনের পর দিন উন্নত হয়েছে এবং বর্তমানে এটি পৃথিবীর অন্যতম একটি ভাষা।
লিথুনিয়ান ভাষা
বেশিরভাগ ইউরোপীয়ান ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য। এরা খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দ হতে আলাদা হতে শুরু করে। জার্মান, ইটালিয়ান, ইংরেজী ভাষাগুলোর মধ্যকার পার্থক্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। কিন্তু একটি ভাষায় সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের আগেকার প্রোটো-ইন্দো-ইউরোপিয়ান ভাষার বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য আজো বিদ্যমান। যে কারণেই হোক, লিথুনিয়ান ভাষায়, ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষার যে পরিমাণ উচ্চারণ, ব্যাকরণ প্রোটো ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা হতে এখনো অক্ষত রয়েছে, তা এই ভাষার অন্যান্য কাজিনদের তুলনায় অনেক বেশি। এই জন্যই লিথুনিয়ান ভাষা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ভাষা।
ফারসি
অধুনা ইরান, আফগানস্তান এবং তাজিকিস্তানের ভাষা এই ফার্সি। প্রাচীন পারস্য দেশের ভাষা থেকে এর পার্থক্য খুব একটা বেশি নয়। একজন নেটিভ ইংলিশ স্পিকার যতটা না সহজে শেক্সপিয়ার পড়তে পারে, এর চেয়ে অনেক সহজে একজন ফারসি ভাষাভাষী একটি ৯০০ শতকের একটি লেখা পড়তে পারবে।
আইসল্যান্ডিক
ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষাগোষ্ঠির নর্থ জার্মানিক শাখার একটি ভাষা হল আইসল্যান্ডিক। (উল্ল্যেখ্য, ইংরেজিও একটি জার্মানিক ভাষা, তবে সেটা ওয়েস্ট জার্মানিক) স্বাভাবিক ভাবেই আর দশটি অন্য ভাষার মত এই নর্থ জার্মানিক ভাষাগুলোও তাদের মূল ইন্দো ইউরোপীয় ভাষা থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছে। কিন্তু আইসল্যান্ডিক ভাষা বেশ রক্ষণশীল ভাবেই উন্নতি লাভ করেছে, এবং ইন্দো ইউরোপীয় অনেক বৈশিষ্ট্য তার মাঝে এখনো বিদ্যমান। আইসল্যান্ডিক ভাষাভাষীরাও সহজেই তাদের শতবছরের পুরোনো সাগা পড়তে পারে অতি সহজেই।
মেসিডোনিয়ান
এই ভাষাটি স্লাভিক ভাষা পরিবারের সদস্য। এই পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হল, রুশ, পোলিশ, চেক, ক্রোট ইত্যাদি ভাষা। এই ভাষা গোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত নতুন। সন্ত ক্রিল এবং মেথোডিয়াস এই স্লাভিক ভাষার উন্নয়ন সাধন করেন এবং একটি বর্ণমালা প্রণয়ন করেন, যাকে এখন বলা হয় ওল্ড চার্চ স্ল্যাভোনিক। এরাই স্ল্যাভনিকদের মাঝে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করেন। নবম শতকের এই ওল্ড চার্চ স্লাভোনিক ভাষা, বর্তমান মেসিডোনিয়ান ভাষার সাথে অনেকটাই মিলে যায়।
ফিনিশ
ষোল শতকের পূর্বে ফিনিশ ভাষার লিখিত কোন প্রমাণ পাওয়া না গেলেও এ ভাষার ইতিহাস অনেক পুরোনো। এই ভাষাটি ফিনো উগ্রিক ভাষা পরিবারের সদস্য। যে পরিবারে আছে এস্তোনিয়ান, হাংগেরিয়ান সহ অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সাইবেরিয়ান ভাষা। অন্যান্য ভাষার অনেক শব্দই ফিনিশ ভাষায় ঢুকে পড়লেও সেই শব্দগুলো একেবারে প্রাচীন ভাষার এবং মোটামুটিভাবে অক্ষতই রয়ে গেছে। “aiti” শব্দটি একটি গোথিক শব্দ। যে ভাষা অনেক আগেই বিলুপ্ত হয়েছে। রাজা বা king শব্দের ফিনিশ প্রতিশব্দ kuningas যা এসেছে পুরাতন জার্মানিক ভাষার শব্দ kuningaz থেকে, যা বর্তমান কোনো জার্মানিক ভাষাতেই নেই।
জর্জিয়ান
ককেশাস অঞ্চল হল পৃথিবীর কঠিনতম ভাষা গুলোর তীর্থস্থান। এই অঞ্চলের তিনটি দেশের মূল ভাষা গুলো তিনটি সম্পূর্ণ আলাদা ভাষাগোষ্ঠী থেকে এসেছে। আর্মেনিয়ান ভাষা একটি ইন্দো ইউরোপিয়ান ভাষা, আযারবাইজানি ভাষা টার্কিশ ভাষা পরিবারের সদস্য এবং জর্জিয়ান ভাষা কার্তেভেলিয়ান ভাষা পরিবারের সদস্য। জর্জিয়ান ভাষা সর্ববৃহৎ কার্তেভেলিয়ান ভাষা, এবং এটিই একমাত্র প্রাচীন ককেশীয় ভাষা। বর্ণমালাগুলো বেশ পুরোনো এবং সুন্দর দেখতে, এবং ধারণা করা হয় এই বর্ণমালা তৃতীয় শতকের দিকে আরামাইক ভাষা থেকে অনূদিত। মজার ব্যাপার এই কার্তেভেলিয়ান ভাষাগোষ্ঠীর মাত্র চারটি সদস্য, যেগুলো এই জর্জিয়ারই আদিবাসীদের ভাষা এবং পৃথিবীর অন্য ভাষার চেয়ে আলাদা।
আইরিশ গেইলজ
আইরিশ গেইলজ আয়ারল্যান্ডের বেশ অল্প কিছু লোকের ভাষা হলেও এর পেছনে আছে লম্বা এক ইতিহাস। ইন্দো ইউরোপীয়ান ভাষা গোষ্ঠীর কেল্টিক শাখার সদস্য এই ভাষা গ্রেট ব্রিটেন এবং আয়ারল্যান্ডের কিছু দ্বীপে জার্মানিক ভাষার আগমনের পূর্বেই ছিল । এই ভাষা থেকেই স্কটিশ গেইলজ এবং ম্যানক্স (manx, Isle of Man এর ভাষা) ভাষার উৎপত্তি হয় এবং এই ভাষাতেই পশ্চিম ইউরোপের সবচেয়ে পুরাতন ভার্নাকুলার সাহিত্যের ছাপ পাওয়া যায়।
(কালচার ট্রিপ ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ল্যানি সিলিংগারের প্রবন্ধ হতে অনূদিত)