বাক্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
পৃথিবীর ভূস্বর্গ কাশ্মীরের ইতিবৃত্ত

মিরাজুল ইসলাম: আনুমানিক ১০ লক্ষ বছর আগে কাশ্মীর ছিলো হ্রদে পরিপূর্ণ। পরে ভূ-উপত্যকায় রূপান্তর হয়। প্রাচীন পৌরাণিক মানচিত্রে চার পাপড়িওয়ালা ফুলের সন্ধিস্থলে কাশ্যপের মিরু পর্বত এলাকাটিকেই হিমালয় বেষ্টিত ভূস্বর্গ কাশ্মীর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার দুই পাশে ছিলো মহাসাগর।
কাশ্মীর শব্দটি প্রাচীন সংস্কৃত ভাষা থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং যাকে káśmīra নামে অভিহিত করা হয়। নীলমত পুরাণ অনুসারে সতী-সরস নামক হৃদের পানি থেকে এই উপত্যকার উৎপত্তি ঘটে। অনিশ্চিত এক জনশ্রুতি অনুসারে ‘কাস্মীর’শব্দের স্থানীয় ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল পানি থেকে উদ্ভূত ভূমি। ককেশিয়ান জনগোষ্ঠি পান্জাব ও কাশ্মীরের আদি গোষ্ঠী।
১ম সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে কাশ্মীর অঞ্চল হিন্দুধর্ম ও পরে বৌদ্ধধর্মের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। নবম শতাব্দীতে কাশ্মীরে শৈববাদের উত্থান ঘটে। খৃ: ১ম শতাব্দীতে কুশান সাম্রাজ্যের সম্রাট কনিষ্ঠ-এর সময়ে ছর্কা (Charaka) ছিলেন রাজ্যের প্রধান চিকিৎসক। ‘ছর্কা-সংহিতা’ তাঁর লেখা প্রথম আয়ুর্বেদ গ্রন্থ। সময়ের কালস্রোতে এর মূল অংশ হারিয়ে গেলে ৯ম শতাব্দীতে দৃধবালা নামের এর কাশ্মিরি চিকিৎসক নতুন করে ছর্কা-সংহিতা রচনা করেন। পরে তা পার্সি ও আরবী ভাষায় অনুবাদ করা হয়। কাশ্মীর উপত্যকার অধিবাসীদেরকে ‘কাশ্মিরি পণ্ডিত’ বা ‘কাশ্মীরি ব্রাহ্মণ হিন্দু’ বলা হয়। তাদের ব্রাহ্মণ বিবেচনা করা হয়। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের ৫০০০ বছরেরও বেশি ইতিহাস আছে। কাশ্মীর প্রদেশের হিন্দু জাতি ব্যবস্থা ছিল অশোকের বৌদ্ধধর্ম প্রভাবিত।
কলিঙ্গ দখল করার পর সম্রাট অশোক বুদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন এবং কাশ্মীরের শ্রীনগর পত্তন করেন। অশোকের সময়ে মূলত হিন্দুকুশ সীমানা পর্যন্ত কাশ্মির তৃতীয় শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিল। কাশ্মীরি সমাজের অন্য একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল সেই সময়ের অন্যান্য সম্প্রদায়গুলির তুলনায় নারীর প্রতি শ্রদ্ধারোধ ছিলো বেশী। পরবর্তীতে ৯৭৫-১০২৫ সাল নাগাদ শৈব দার্শনিক অভিনবগুপ্ত কাশ্মির অন্চলে শৈব মতবাদ প্রচলন করেন। যা সেখান থেকে দক্ষিণ ভারতে তামিল অব্দি বিস্তৃতি লাভ করে। গড়ে ওঠে প্রচুর শিব মন্দির। চতুর্দশ শতাব্দীতে পুনরায় কাশ্মির এলাকায় বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব দেখা দেয় মূলত রিনচানা’র শাসনামলে। অত্যন্ত নিষ্ঠুরতার সাথে তিনি হিন্দুদের দমন করেছিলেন। চতুর্দশ শতাব্দীর শেষ ভাগে মুসলিম শাসন শেষ পর্যন্ত উপত্যকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো।
১৩৩৯ সালে শাহ মীর কাশ্মীরের প্রথম মুসলমান শাসক হন এবং সালতিন-ই-কাশ্মীর বা শাহ মীর রাজবংশের গোড়াপত্তন করেন। তবে পন্চদশ শতাব্দীতে শাহ মীর বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন জয়নুল আবেদীন (১৪২০-১৪৭০) -এর শাসনামলে কাশ্মির তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল ছিলো। তিনি এর আগের মুসলিম শাসকদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত মন্দিরের পুণ:নির্মাণ করেন, জোর করে ধর্মান্তকরণ বাতিল করেন, গো-হত্যা নিষিদ্ধ করেন, ধর্মান্তরিত হিন্দুদের আবার স্বধর্মে ফেরত যাবার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
কাশ্মীর ১৫৮৬ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। সম্রাট আকবরের আমলে আর্মেনিয়া ও মধ্য এশিয়া অন্চল হতে খৃস্ট ধর্ম কাশ্মির উপত্যকায় স্থায়ীভাবে অনুপ্রবেশ করে। ১৮২০ সাল পর্যন্ত কাশ্মির আফগান দুররানি সাম্রাজ্যের অংশ ছিলো। সেই বছরই রঞ্জিত সিঙের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে। উত্তর ভারতের ঐতিহাসিকভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক অঞ্চলটি আঠারো শতকের পর তুর্কি ও আরব শাসকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে।
১৮৪৬ সালে প্রথম ইঙ্গ-শিখ যুদ্ধে শিখরা পরাজিত হয় এবং জম্মুর রাজা গুলাব সিং অমৃতসর চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে এই অঞ্চল ক্রয় করে কাশ্মীরের নতুন শাসক হন। এর আগে ১৮১৯ সালে কাশ্মীর উপত্যকা দুররানি সাম্রাজ্যের হাত থেকে পাঞ্জাবের রঞ্জিত সিঙের অধীনে শিখদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তার উত্তরসূরিরা ব্রিটিশদের অধীনে এই অঞ্চলের শাসন করে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাজনের পূর্ব পর্যন্ত।
ভারত বিভাজনের পর সাবেক ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্যের এই রাজ্যটি অমীমাংসিত অঞ্চলে পরিণত হয় এবং বর্তমানে কাশ্মীর ভূখণ্ড তিনটি দেশের নিয়ন্ত্রণে। লাদাখসহ জম্মু ও কাশ্মীর ভারতের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে কাশ্মীরের পশ্চিম অংশ। আর চীনের নিয়ন্ত্রণে আছে এর উত্তরের কিছু অংশ।