বাক্য
প্রকৃতির পাহারাদার যাদব পায়েং

ফজজুল হালিম রানা: এই লোকটাকে আমি অসম্ভব ঈর্ষা করি। যদিও আমাদের দেশে তাঁকে নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি নেই তবে ইন্ডিয়া থেকে শুরু করে গোটা দুনিয়ায় তাঁকে নিয়ে একটা আবেগের ঢেউ আছে। ন্যাচার ম্যাগাজিনসহ পৃথিবীর খুব কম নামীদামি পত্রিকা আছে যাতে তাঁর ঠাই হয় নাই! ফিল্ম, ডকুমেন্টারি এরকম বহু কিছু আছে তাঁকে নিয়ে।
তিনি ভারতের যাদব পায়েং পেয়েছেন পদ্মশ্রীসহ জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘’দ্য ফরেষ্ট ম্যান অফ ইন্ডিয়া’ খেতাব। পৃথিবীর মানুষ এখন তাঁকে দ্য ফরেষ্ট ম্যান অফ ইন্ডিয়া এ নামেই চিনে। কাজটা শুরু করেছিলেন মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৭৯ সনে। ২০ টি বাঁশের চারা রোপণের মধ্য দিয়ে ভারতের আসামের জোড়হাট জেলার কোকিলামুখের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদের মাজুলি দ্বীপে শুরু হয়েছিল তাঁর যাত্রা।
গত ৪০ বছর যাবত তিনি প্রথমে ২০ মিনিট পায়ে হেঁটে পরে নৌকা চালিয়ে নদী পার হতেন এবং তারও পরে আরও দু’ঘণ্টা হেঁটে সেই দ্বীপে পৌঁছতেন,যেখানে তিনি প্রতি বছর তিন মাস ধরে গাছ লাগাতেন। অবশ্য গত কিছু বছর যাবত তিনি এখন তাঁর হাতে গড়া প্রায় ১৪০০ একরের বিস্তীর্ণ ওই বনভূমিতেই থাকেন। মাত্র ২০ টি গাছ লাগানোর মাধ্যমে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা এখন তাঁর নামানুসারে মোলায় রিজার্ভ ফরেস্ট নামে পরিচিত। এই রিজার্ভ ফরেস্ট নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল ফরেস্টের থেকেও দ্বিগুণ!
যাদব পায়েং এর সৃষ্ট এই বনে বা জংগলে আছে চিতাবাঘ, অসমের বিখ্যাত খর্গী গণ্ডার, হরিণ, বাদর ও বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। এখানে লাগানো গাছের মধ্যে বাঁশ, অর্জুন,বিশাল সব সেগুন ও কৃষ্ণচুড়াসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ । আছে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার বাঁশ। শুধু তাই নয় নিজের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি এখন রাজস্থান, উত্তর ঝাড়খন্ডসহ বিভিন্ন জায়গায় গাছ লাগাতে ছুটে যাচ্ছেন। এইত কিছুদিন আগেও তিনি ঝাড়খন্ডের প্রায় ২৭০০ পোস্ট অফিসের সামনে একটি করে গাছ লাগিয়েছেন! এটা প্রতীকী। তাঁর দর্শন অত্যন্ত চমৎকার এবং একদমই সোজাসাপটা। তিনি মনে করেন মাটিতে বীজ ফেললে গাছগুলি নিজেই জন্মে। তিনি বলেন, প্রকৃতি এভাবেই কাজ করে আপনি এটিকে কিছুটা সহায়তা করুন এবং এটি নিজেই পাল্টা সহায়তা করবে।
পেশায় দুধ বিক্রি করে চলা যাদব পায়েং জংগলের মধ্যে ২০০ টি গাভী পালেন। সবচেয়ে অবাক তথ্য দুধ বিক্রির এই টাকা দিয়ে তিনি নিজেরসহ ৩০০ আদিবাসী পরিবার চালান। এই পরিবার গুলোর আয়ের একমাত্র উৎস যাদব! বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে তিনি নিজেকে সুখী মানুষ এবং প্রকৃতির পাহারাদার বলে দাবী করেন। এই মানুষটা নিজ হাতে একটা পৃথিবী তৈরি করেছেন! বিশাল এক জংগলের জন্ম দিয়েছেন! এখন এই মানুষটা আবার একটি বই নিয়ে কাজ করছেন। যার লক্ষ্য হচ্ছে শিশুদের বর্তমান সময়ে গাছ লাগানোর প্রক্রিয়া এবং গুরুত্ব শেখানো।
এই ফরেস্ট ম্যান আজও নিজের এই জংগলে গাছ লাগিয়ে যাচ্ছেন। এবং এও বলেছেন যে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ না করা পর্যন্ত তিনি এ কাজ চালিয়ে যাবেন! এবার নিশ্চয়ই বুঝছেন কেন তাঁকে আমার ঈর্ষা হয়! প্রকৃতির প্রতি কি নির্মোহ ভালোবাসা! আসলে মানুষ যখন কোন ভালোবাসায় আটকে যায় তখন সে আর তা থেকে বের হতে পারেনা। ফরেস্ট ম্যান, আপনার প্রতি অবিরাম ভালোবাসা! আপনি পৃথিবীকে ভালোবাসেন। প্রকৃতিকে ভালোবাসেন। আমরা আপনাকে ভালোবাসি। স্যালুট আপনাকে।