খেলা
ফর্মুলা ওয়ানের ইতিবৃত্ত

মঞ্জুর দেওয়ান: ক্রিকেট-ফুটবলের বাইরে বাংলাদেশে জনপ্রিয় খেলা নেই বললেই চলে। গুটি কয়েক মানুষের অন্য খেলার প্রতি আগ্রহ থাকলেও, প্রয়োজনীয় উপকরণ আর সুযোগের অভাবে খেলা হচ্ছেনা উন্নত দেশের জনপ্রিয় খেলা। এই যেমন ফর্মুলা ওয়ান! উন্নত দেশের তুমুল জনপ্রিয় খেলাটি আমাদের দেশে খেলা তো দূরে থাক; প্র্যাক্টিস করার অবকাশ পর্যন্ত নেই! থাকবেই কি করে, বড়লোকের এ খেলার জন্য দরকার বিশাল সার্কিট (ফর্মুলা ওয়ানের গ্রাউন্ড)। ছোট্ট আয়োতনের দেশে এমন খেলার আয়োজনকে অনেকে বিলাসিতা বললেও বলতে পারেন। তবে সঠিক বিনিয়োগকারীর দেখা মিললে হয়তো বাংলাদেশেও একদিন চালু হবে এই প্রতিযোগিতা। নতুন বার্তার পাঠকদের জন্য এবারের আয়োজন ফর্মুলা ওয়ান রেসিং নিয়ে।
ফর্মুলা ওয়ান হলো এক সিট বিশিষ্ট গাড়ি প্রতিযোগিতা। যা ১৯২০-৩০ এর দশকে শুরু হয়। গ্রাঁ প্রি মোটর রেসিং থেকে ফর্মুলা ওয়ানের উৎপত্তি হয়েছে। তবে বৈশ্বিক ফর্মুলা ওয়ান টুর্নামেন্টের উদ্ভোধন হয়েছে ৫০ এর দশকে। বিশ্বের ৬৮ টি ভিন্ন সার্কিটে অনেকগুলো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশীপ গাড়ি রেসিং এর আয়োজন করা হয়েছে।
সাড়ে ছ’শো কিংবা সাত’শো কিলোগ্রাম ওজনের হালকা একটি গাড়ি অথচ ঘন্টায় তিনশো কিলোমিটারের বেশি গতিতে চলে। ভাবা যায়! খেলনা গাড়ির আদলে তৈরি গাড়িতে ড্রাইভ করতে শারীরিক কসরত খাটাতে হয়। নিয়ন্ত্রণ করতে হয় আধা শুয়ে আর আধা বসে! ফর্মুলা ওয়ানের গাড়ি গুলোর বৈশিষ্ট্য অনেকটা এরকমই। অবাক শোনালেও সত্যি যে, ফর্মুলা ওয়ান রেসিং কারে কোন গিয়ার স্টিক নেই। স্টিয়ারিং এ থাকা বিশেষ বোতামের মাধ্যমে গিয়ার বদলাতে হয়। সংকীর্ণ জায়গার কারণে এই গাড়িতে পা মেলে বসা দায়। পুরো গাড়িই যেন ফুয়েল ট্যাংকে ভর্তি!
হালের বিলাসবহুল গাড়ির ঠিক উল্টো রূপ লক্ষ্য করা যায় ফর্মুলা ওয়ানে ব্যবহৃত গাড়িতে। এসি তো দূরে থাক; প্রচণ্ড গরমে টিকে থাকা দায়। রেসারদের অভিজ্ঞতা থেকে শোনা যায়, রেস শেষে প্রায় ৪ কেজি ওজন কমে যায়! আর বিশেষজ্ঞদের তথ্যমতে, ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে রেসারদের শরীর থেকে প্রায় ৩ লিটার পানি ঝরে যায়। আর এই পানি শূন্যতা দূর করতে হেলমেটের সুবিধা নেন রেসাররা। কেননা, গাড়িতে থাকা পানির বোতল থেকে একটি পাইপ তাদের হেলমেটে সংযুক্ত করে দেন। প্রয়োজন অনুযায়ী এখান থেকেই পানির চাহিদা মিটিয়ে থাকেন রেসাররা।
রেসিং শেষে প্রতিটি টায়ার থেকে প্রায় ৫০০ গ্রাম করে ওজন কমে যায়। গাড়ির তুলনায় অধিক বড় টায়ারগুলো সেকেন্ডে ৫০ বার ঘুরে। শুধু গাড়ি দেখে বুঝবার উপায় নেই, কোনটায় কোন রেসার বসে আছে। তাই ফর্মুলা ওয়ানের ড্রাইভারদের পরিচয় জানতে নাম্বার দেয়া হয়। ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নকে ১ আর তার সতীর্থকে দেয়া হয় ২। সংখ্যায় মোটামুটি সব নাম্বার দেয়া হলেও ‘১৩’ নম্বরটি দেয়া হয়না। ফর্মুলা ওয়ানের ইতিহাসে ১৩ সংখ্যাটি দুইবার ব্যবহার হলেও এখন বাতিল করা হয়েছে। ‘আনলাকি থার্টিন’ তত্ত্ব মেনে এটি কাউকে দেয়া হয়না। ১৩ নাম্বার নিয়ে অংশ নিয়ে দুটি বড় দূর্ঘটনা ঘটেছে। ১৯২৫ সালে পল টর্সি ও ১৯২৬ সালে কন্ত গিউলিও ম্যাসেতির দূর্ঘটনার পর থেকে ১৩ নাম্বারকে অপয়া মনে করা হয়।
এক সিটের সুপার স্পিডের গাড়ির দাম শুনলে চোখ ছানাবড়া হতে পারে। প্রতিটি গাড়ির পেছনে ৮ থেকে ১০ মিলিয়ন ডলার খরচ করে কোম্পানিগুলো। শতভাগ ত্রুটিমুক্ত না হলে রেসারদের ঢুকতে দেয়া হয়না।
প্রচণ্ড গতিতে চলতে থাকা গাড়িটির ব্রেক কষা নিয়েও সতর্ক থাকতে হয়। পান থেকে চুন খসলেই বিপদ! গাড়ির ব্রেক তৈরিতে ব্যবহৃত হয় কার্বন ফাইবার। রেসিংকালে এর তাপমাত্রা ১২০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসকে ছাড়িয়ে যায়। যা প্রায় মোল্টেন লাভার গড় তাপমাত্রার সমান। ব্রেক কষলে রেসার যে পরিমাণ ত্বরণের সম্মুখীন হন, তা দিয়ে একটি ইটের দেয়াল ভেঙ্গে গাড়ি চালানো যাবে! ফর্মুলা ওয়ান ড্রাইভারদের দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। বিচক্ষণতার অভাব দেখা দিলেই মুশকিল। রেসিং সার্কিটে থাকা যেকোনো বাঁকে একটি মাত্র ভুল সিদ্ধান্তই হতে পারেন প্রাণ নাশের কারণ!
প্রচণ্ড নিয়মের মধ্য দিয়ে চলা এই রেসিং এ এখন পর্যন্ত একজন নারী রেসার স্কোর করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এ যাবতকাল ৫ জন নারী অংশ নিলেও স্পেনের গ্র্যান্ড প্রিক্সে ছাড়া আর কেউ কোন স্কোর করতে পারেননি। ১৯৭৫ সালে প্রিক্সে ০.৫ পয়েন্ট করে ষষ্ঠ হয়েছিলেন।
প্রাণঘাতী জেনেও উন্নত দেশগুলোতে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে এই প্রতিযোগিতাটি। এখন পর্যন্ত ৪৬ জন রেসার প্রাণ হারিয়েছেন এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে। তবে প্রযুক্তির বিকাশে মৃত্যুর হার অনেকটাই কমেছে। রেসিং সার্কিটে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯৪ সালে।