বই Talkহোমপেজ স্লাইড ছবি
ফ্রান্ৎস কাফকা: রূপান্তরের নায়ক

মাহমুদুর রহমান: তাঁকে বলা হয়েছে বিংশ শতাব্দীর সর্বাধিক প্রভাবশালী লেখক। কাফকা যেমন পাঠককে প্রভাবিত করেছেন, ততোধিক প্রভাবিত করেছেন তাঁর সময়ের এবং তাঁর পরবর্তী কালের লেখকদের।
কাফকার জন্ম ১৮৮৩ সালের প্রাগ শহরের ওল্ড টাইন স্কয়ার এলাকায়। কাফকা ছিলেন জার্মানভাষী মধ্যবিত্ত ইহুদী পরিবারের সন্তান। হারমেইন এবং জুলির ছয়টি সন্তানের মধ্যে ফ্রান্ৎস কাফকা ছিলেন জ্যেষ্ঠ। ফ্রান্ৎস কাফকা যখন শিশু ছিলেন তখন জার্মানিতে অনেক প্রকরণের জার্মান ভাষায় মানুষ কথা বলত, তবে সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষের সাথে অনায়াসে মেলামেশার স্বার্থে ফ্রান্ৎস কাফকার বাবা-মা তাকে উচ্চ শ্রেণীর জার্মান শিখতে অনুপ্রেরণা যোগান।
কাফকার প্রাথমিক শিক্ষা চলে ১৮৮৯ থেকে ১৮৯৩ সাল পর্যন্ত। এ সময় তিনি ডয়েচ ক্যানাবেনশুল জার্মান বয়েজ এলিমেন্টারি স্কুলে লেখাপড়া করেন। পরবর্তীতে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি হন। স্বাভাবিক ভাবে সে স্কুলে জার্মান ভাষায় পাঠদান করা হলেও কাফকা চেক ভাষায় পারদর্শী ছিলেন।
কাফকার সহপাঠী এবং অন্যান্যরা সব সময়ই খেয়াল করতেন যে ছেলেটি অন্তর্মুখী। কখনও কখনও তাঁকে সন্দেহপ্রবনও মনে হতো। যদিও তিনি আইনে আগ্রহ রাখতেন না কিন্তু আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি ইদিশ লেখকদের বই পড়ে উদ্বুদ্ধ হন। অন্তর্মুখী মানুষটি সব সময়েই একজন বুভুক্ষু পাঠক ছিলেন। কাফকা কেবল অন্তর্মুখীই নন, তিনি ছিলেন বিষণ্ণ, কোন কারণে ভীত। একটা বিষণ্ণতা আর ভয় তাঁকে তাড়িয়ে গেছে সব সময়। তাঁর লেখায় এর প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি।
ইদিশের সাথে দস্তয়ভস্কি, ফ্লবেয়ার, ফ্রানৎস গ্রিলপারসার, গ্যেটের লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এক সময় তিনিও লেখা শুরু করেন। শারীরিক এবং মানসিক নিষ্ঠুরতা, বিচ্ছিন্নতাবোধের আদিরূপ, পিতা-মাতা-সন্তানের দ্বন্দ্ব, আতঙ্ক, আমলাতন্ত্রের গোলকধাঁধা আর রহস্যময় রূপান্তরকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে কাফকার অধিকাংশ রচনা। সমাজের বিভিন্ন দিক, বিভিন্ন সময় উদ্ভট রূপ পেয়েছে তাঁর উপন্যাসে, ছোট গল্পে।
উদাহরণ স্বরূপ আমরা তাঁর বিখ্যাত ‘মেটামরফোসিস’ গল্পটি ধরতে পারি। যেখানে একজন সেলসম্যান ঘুম ভেঙে দেখতে পায় সে একটি পোকায় পরিণত হয়েছে। কাফকার এ গল্প নিয়ে পৃথিবীতে বহু সমালোচনা লেখা হয়েছে। এখানে আমি কেবল বলবো এ লেখায় ফুটে উঠেছে এমন কিছু নৈব্যক্তিক ভয় যা আমরা যাপন করি প্রতিদিন। ‘দ্য ট্রায়াল’ গল্পে ব্যাংক কর্মচারী ইয়োসেফকে এক সকালে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বড় কোনো অপরাধ না করেই এবং শেষ পর্যন্ত তিনি জানতেই পারলেন না তাঁর বিরুদ্ধে আসল অভিযোগটা কী৷ এমনকি বিচারকের সামনেও তাঁকে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি।
কাফকার অন্যান্য রচনায়ও এসব বিশয়ই দেখা যায়। মূলত যে সময়ে তিনি জন্মেছিলেন এবং বেড়ে উঠেছিলেন তখন পৃথিবী একটা ভাঙা গড়ার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলো। কাফকা সে সময় দেখেছেন। মানুষের প্রতি অন্যায় অবিচার দেখেছেন। গুটিয়ে গেছেন অনেক বেশি করে। তবু তাঁর বিষণ্ণতা আর ভয়ের মধ্যে দিয়েই সৃষ্টি করেছেন ‘রায়’, ‘দুর্গ’, ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার’, ‘আইনের দরজায়’, ‘সম্রাটের কাছ থেকে বার্তা’-র মতো একেকটি লেখা।
লেখক পাঠক সকলেই জানেন, কাফকার কোন লেখাই সরাসরি অর্থ করা যায় না। একেকটি লেখা অত্যন্ত গভীর। সময় নিয়ে ভেবে চিন্তে পাঠ করলে তাৎপর্য বোঝা যায়। কিন্তু কাফকা তাঁর লেখার মাঝে রেখে গেছেন নানা প্রশ্ন, নানা কঠিন বাস্তবতা।
বিষণ্ণ মানুষটি যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর সেই রোগেই মারা যান ১৯২৪ সালের। তবে আজকে কাফকার জন্মদিন। জন্মদিনে তাঁকে জানাই শ্রদ্ধা।