প্রিয় তারকাবিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
বাঙালীর রোমান্স কিংবা নষ্টালজিয়া জুড়ে সুচিত্রা সেন

সাবা তারান্নুম: বাঙালী দর্শক বড় পর্দায় প্রথম যে নারীর ভুবন ভুলানো হাসি আর অভিনয়ের প্রেমে পড়ে তিনি আর কেউ নন, বাঙালীর নষ্টালজিয়া সুচিত্রা সেন। অভাবনীয় অভিনয় আর সৌন্দর্য্যের অধিকারী এমন নায়িকা ছিলেন একজনই। যার তুলনা আজও হয়না। উত্তমের সাথে জুটি বাঁধার পর এই নায়িকার থেমে থাকতে হয়নি। সিনেমার পর্দায় এই দুই অভিনেতা অভিনেত্রীর হৃদয়স্পর্শী রোমান্স আর অসাধারণ অভিনয় নৈপুণ্য তাদের নিয়ে গিয়েছিলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে। কিন্তু হঠাৎ করেই সিনেমার চাকচিক্যের দুনিয়া ছেড়ে লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান আমাদের প্রিয় অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন। যা থেকে সৃষ্টি হয়েছে নানান মিথ আর নানান কৌতুহল।
১৯৩১ সালে রমা সেন এপার বাংলার পাবনা শহরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রমা সেন এর পর্দায় নাম হয় সুচিত্রা সেন। দেশবিভাগের পর কলকাতায় পাড়ি জামায় সুচিত্রার পরিবার। সেখানে নবম শ্রেণিতে অধ্যায়নরত অবস্থায় তার বিয়ে হয় বিখ্যাত শিল্পপতি আদিনাথ সেনের পুত্র মেরিন ইঞ্জিনিয়ার দিবানাথ সেনের সাথে। মিষ্টি হাসির আর মায়াবী চাহনির এই নায়িকার ‘শেষ কোথায়’ সিনেমার মাধ্যমে বড় পর্দায় অভিষেক ঘটলেও সিনেমাটি মুক্তি পায়নি। এরপর ১৯৫৩ সালে মুক্তি প্রাপ্ত ‘সাড়ে চুয়াত্তরে’ উত্তম-সুচিত্রার জুটি কেড়ে নেয় হাজারো দর্শকের মন। ১৯৫৫ সালে ‘দেবদাস’ সিনেমায় অভিনয় করে পুরস্কৃত হন সুচিত্রা সেন।
‘কাজরী’, ‘এ্যাটম বোম্ব’,’অগ্নিপরীক্ষা’, ‘বলয়গ্রাস’,’সাজঘর’,’সাজঘর’,’চম্পাকলি’,’চাওয়া পাওয়া’ সহ পঞ্চাশেরও অধিক সিনেমায় অভিনয় করেন এই গুণী অভিনেত্রী। এছাড়াও ‘দ্বীপ জেলে যাই’ সিনামার নার্সের চরিত্রের জন্য অসংখ্য প্রশংসা কুড়িয়েছেন তিনি। ‘উত্তরফাল্গুনী’ ছবিতে যৌনকর্মী পান্নাবাই ও তার কন্যা আইনজীবী সুপর্ণার দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সুচিত্রা সেন। সময় ফাঁকা না থাকার কারণে সত্যজিৎ রায়ের ‘চৌধুরানী’ ছবিতে কাজ করতে অপরাগতা প্রকাশ করেন ব্যস্ত এই নায়িকা। এ কারণে অস্কারজয়ী পরিচালক সত্যজিৎ রায় ছবিটি আর বানাননি।
হিন্দী সিনেমাতেও অসামান্য অভিনয়ের ছাপ ফেলে গেছেন সুচিত্রা। যার মধ্যে অন্যতম ‘আন্ধি’,’মুসাফির’,’মুম্বাই কা বাবু’। সর্বশেষ সুচিত্রা অভিনয় করেন ‘প্রণয়পাশা’ সিনেমাটিতে। এরপর আর বড়পর্দায় দেখা যায়নি এই মহানায়িকাকে। নিজেকে একরকম জনমানুষের সহচর্য থেকে দূরে সরিয়ে নেন। এই আড়াল জীবনে প্রবেশাধিকার ছিল শুধুমাত্র তার একমাত্র কন্যা মুনমুন সেন, দুই নাতনি রিয়া সেন, রাইমা সেন আর কিছু আপন জনের। এরপর থেকে বেশিরভাগ সময় রামকৃষ্ণ মিশনে কেটেছে তার। এমনকি তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি দাদাসাহেব ফালকে খ্যাতি গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। কেননা এই পুরষ্কার গ্রহণ করতে হলে তাকে মুম্বাই গিয়ে জনসম্মুখে আসতে হতো। অভিমানী এই নায়িকা কেন প্রায় সাড়ে তিন দশক লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে গেলেন এ যেন বাঙালীর মনে এখনো এক বিস্ময়।
উপমহাদেশের প্রথম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন যিনি আন্তর্জাতিক পুরষ্কারে সম্মানিত হন। ১৯৬৩ সালে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে ‘সাত পাকে বাঁধা’ ছবির জন্য এই স্বীকৃতি পান তিনি। পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে এক চেটিয়া আধিপত্য চালিয়ে যান এই নায়িকা। নজরকড়া অভিনয়, সাজসজ্জা, মোহনীয় বাচনভঙ্গী আর সার্বিক সৌন্দর্য বাঙালী দর্শককে মুগ্ধ করেছে তার সুদীর্ঘ পথচলার প্রতি মুহুর্তে। দর্শকপ্রিয় এই নায়িকা তার অভিনয় মাধুর্যেই কেবল নয় আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বও তাকে একটি ঈর্ষণীয় অবস্থানে নিতে বাধ্য করেছে তার ভক্তকূলের কাছে।
সুচিত্রার চালচলন বেশভূষা হয়ে উঠেছিল বাঙালী নারীর ফ্যাশানের মূল উৎস। সেচ্ছা নির্বাসন গ্রহণকারী এই মহানায়িকা কোটি মনের ভালোবাসা কুড়িয়ে ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি চিরকালের জন্য আড়ালে চলে যান। আজও সুচিত্রা সেন সর্বদাই বাঙালীর জন্য বাংলা চলচ্চিত্রেরের চির সবুজ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নায়িকা।