ছুটিহোমপেজ স্লাইড ছবি
ভয়ংকর সুন্দরের খোঁজে ঘুরে আসুন কির্সতং!

মৃন্ময়ী মোহনা : পাহাড়-চূড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল! আমি এই পৃথিবীকে পদতলে রেখেছি…
সুনীল বাবু বেঁচে থাকলে তাকে জিজ্ঞেস করতাম, এ পংক্তি কি তিনি কির্সতং অভিযানে সফল হয়ে লিখেছেন কিনা ;নয়তো, এমন খাপে খাপ মিলে গেল কি করে? ২ হাজার ৯৫০ ফুট উঁচুতে উঠে পৃথিবীকে পদতলে রাখার অনুভূতিটাই যেন হয়! দুর্গম পথ, ঘন জঙ্গল, অগণিত ঝিরি, বন্য প্রাণী- সব মিলিয়ে কির্সতং পর্বত এক দুর্দান্ত প্যাকেজ। তবে বান্দরবানের অন্যান্য ট্রেকিং স্পটগুলোর চেয়ে বেশি দুর্গমতার কারনেই কিনা, এর বেশি পরিচিতি এখনো হয়নি।
অন্তর্জালেও খুব বেশি তথ্য এর ব্যাপারে পাওয়া যায়না। তবে, এ পাহাড়ের নামের অর্থটা সুন্দর বটে।
কির্সতং শব্দবন্ধ ভাঙলে দুটো রূপমূল পাওয়া যায়। কিরসা (ছোট পাখি) আর তং (পাহাড়) । খুব সম্ভবত এ দুটো শব্দ মারমা ভাষা থেকে আগত।
কির্সতং অভিযানে যেতে হলে দেশের যেকোন প্রান্ত থেকে যেতে হবে চকরিয়া।এটি কক্সবাজার জেলার একটা উপজেলা। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যাওয়ার পথেই পড়ে। চকরিয়া থেকে পরবর্তী গন্তব্য আলীকদম। এখানে নানাভাবে যাওয়া যায়। সবচেয়ে ভাল হল ৭০/৮০ টাকা ভাড়ায় চান্দের গাড়িতে যাওয়া। এখানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ক্যাম্প আছে। এখানেই নিতে হবে কির্সতং যাবার অনুমতি।এরপরের গন্তব্য হবে ১৩ কিলোমিটার নামের জায়গায়। আলীকদমের পানবাজার এলাকা থেকে মোটরবাইক পাওয়া যায় এখানে যাবার জন্য। এ এলাকায় একদিন রাত্রিযাপন করে পরবর্তী দিনগুলোর জন্য নিজেকে তৈরি করে নিতে হবে। এখানেই অনেক গাইড পাওয়া যাবে। আলাপ আলোচনা করে নিয়ে নিন একজন স্থানীয় গাইড। সকাল সকাল তারপর বেরিয়ে পড়ুন।
কির্সতং যাবার পথে বেশ কিছু আদিবাসী পাড়া পড়বে।৭০০ ফুট উঁচুতে দেখা মিলবে মেনিকিউ পাড়া।তারপর মেনিয়াংক পাড়া -১৯০০ ফুট।
এবার দেখা মিলবে খেমচং পাড়া (২১০০ ফুট) । এখানে কাটিয়ে দিন আরেকটা রাত। পরদিন ভোরবেলা নতুন মনোবল নিয়ে শুরু করুন আবার যাত্রা। গতি ঠিক থাকলে দুপুরের আগেই পৌঁছে যাবেন কির্সতং এর চূড়ায়। তারপর যা সৌন্দর্য দেখবেন, তা দেখে তিনদিনের ক্লান্তি তো ভুলতে হবেই, সাথে আবৃত্তি করে উঠবেন সুনীল বাবুর ওই যে কবিতার লাইনটা…..
শুরুতেই বলেছিলাম, এখানে যাবার পথ ভীষণ দুর্গম। পুরনো গাছপালার ঘন জঙ্গল হওয়ায় বন্য পশু পাখিও আছে বেশ। বন্য পোকামাকড়, জোঁক, মশামাছি এসব ব্যাপারে তাই ভীষণ সচেতন হতে হবে। আর এখানে যাবার পুরো রাস্তাটাই পাহাড়ের ওপর দিয়ে।তাই পোশাক আশাক আর জুতার ব্যাপারট্ও খেয়াল রাখতে হবে বেশ। গাইডের ব্যাপারটায় খুব সতর্ক হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাকে; এবং কেবলমাত্র তাকেই নিতে হবে, যে খুব ভাল মত পথ চিনবে।
স্থানীয় লোকজন খুব বন্ধুসূলভ। মনে রাখবেন, সেখানে তারাই আপনার পরম বন্ধু। তাদের বাড়িতেই আপনার আশ্রয় নিতে হবে, তাদের কাছ থেকেই খাওয়া-দাওয়া সহ অন্যান্য ব্যাপারে সাহায্য নিতে হবে।তাই তাদের সাথে সুসম্পর্ক ও ভাল ব্যবহার বজায় রাখা জরুরি।
কির্সতং চূড়ার সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করবার মত নয়; সেখানে পৌঁছানোর পথের সৌন্দর্য ও আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দেবে।
বনের সবুজ, বুনো ঘ্রাণ, চারপাশে মেঘের নাচন, হঠাৎ পাখ পাখালির অচেনা সুরে ডেকে ওঠা – সবকিছুর মোহময় আবেশ আপনাকে নিয়ে যাবে অন্য এক জগতে। তখন মনে কবিতা আসতেই পারে,
’’একেবারে চূড়ায়, মাথার
খুব কাছে আকাশ, নিচে বিপুলা পৃথিবী,
চরাচরে তীব্র নির্জনতা।
আমার কন্ঠস্বর সেখানে কেউ
শুনতে পাবে না।
আমি শুধু দশ দিককে উদ্দেশ্য করে বলবো,
প্রত্যেক মানুষই অহঙ্কারী, এখানে আমি একা-
এখানে আমার কোন অহঙ্কার নেই।
এখানে জয়ী হবার বদলে ক্ষমা চাইতে ভালো লাগে।
হে দশ দিক, আমি কোন দোষ করিনি।
আমাকে ক্ষমা করো।’’