বই Talk
মিশেল ফুকো : জ্ঞান ও সমাজের প্রত্নতত্ত্ব

মঈন চৌধুরী: মিশেল ফুকো চিন্তা করেন এবং বলেন, আমরা মানুষ, মানবিকতা মানুষের ধর্ম। এ ধরনের একটা আপাতমহৎ এবং স্বার্থপর দর্শনকে চিন্তা-চেতনায় রেখে আমরা চালু রেখেছি ক্ষমতার আয়োজন ও শোষণের সামাজিক প্রক্রিয়া। যদিও আমরা জানি, এ বিশ্বে অনেক অনেক কাল আগে থেকেই অবস্থান করছে প্রাণীরা, পশুরা, মাছেরা, বৃক্ষেরা, বস্তুরা এবং মানুষেরা, তবু এই অতি সাম্প্রতিককালেই আমরা আবিষ্কার করেছি মানুষকে, আর মানুষের ওপরে আরোপিত মানবত্ব আমাদের সাহায্য করছে যুক্তি/অযুক্তি, স্বাভাবিক/উন্মাদ, ক্ষমতা/অক্ষমতা ইত্যাদির মতো যুগ্ম-বৈপরীত্যগুলোর ইচ্ছেমতো ব্যবহার।
রেনেসাঁস পরবর্তী ক্লাসিকাল যুগ থেকেই আমরা অযথা নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছি যুক্তির আবর্তে এবং অযৌক্তিক উন্মাদকে নিক্ষেপ করেছি উন্মাদ আশ্রমে। হঠাৎ করে হয়ে ওঠা এই মানুষ সৃষ্টি করেছে চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, সমাজসংস্কারক বা রাজনীতিবিদ, আমলা, পুলিশ, আর্মি ইত্যাদি নামের কতক ক্ষমতালিপ্সু শ্রেণী এবং এখনো এই শ্রেণীগুলোই বিভিন্ন নামে ও নকশায়, যুক্তি ও অযুক্তির সীমারেখা টেনে, শোষণ করছে সমাজকে। সত্যিকার স্বাধীন সত্তার মানুষকে বন্দি হতে হয়েছে কিছু সামাজিক ও নৈতিক বিধি-নিষেধের কারাগারে, যা যৌক্তিকভাবে তুলনীয় হতে পারে অযৌক্তিক সত্য-সত্তার জন্য সৃষ্ট উন্মাদ আশ্রম কিংবা প্যানঅপটিকান কারাগারের সাথে। প্রকৃতির কিছু দ্বন্দ্ব ও ডায়ালেকটিকস্কে কেন্দ্র করে উনিশ শতকে মানুষ সৃষ্টি করেছে মনোচিকিৎসার এক রূপকথার জগৎ, যার প্রেক্ষাপটে রয়েছে জ্ঞান ও ক্ষমতানির্ভর এক বিশেষ ক্ষমতাকাঠামো।
জ্ঞান ও ক্ষমতা যে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ, এ সত্য প্রকাশ পেয়েছে তথাকথিত যৌক্তিক মানবিক কর্মকান্ডে। জ্ঞান আর ক্ষমতার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়েছে যৌনতা ও যৌন অনুষঙ্গ। আজকের শিকড়হীন মানুষের চিন্তার ইতিহাসও আসলে এক ব্যর্থতার ইতিহাস। প্রত্নতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, ইতিহাসের কোনো ধারাবাহিকতা নেই, জ্ঞানতত্ত্বেও নেই কোনো যুক্তির স্রোত। আসলে যা আছে তা হলো চিন্তাশৃঙ্খলের কিছু বিচ্ছিন্ন জ্ঞানাণু বা এপিস্টেম আর ইতিহাসকেন্দ্রিক কিছু বিভিন্ন দেশ-কালচ্যুতির লক্ষণ।
সময়ের সাথে এপিস্টেম বদলেছে বারবার আর জ্ঞানচর্চা বাধাগ্রস্ত হয়েছে ধারাহীন ইতিহাসের মানবত্ব আরোপণের উদ্ভ্রান্ত প্রচেষ্টায়। জ্ঞানতত্ত্ব ও ইতিহাস সৃষ্টিতে মানুষের ভাষাও পালন করেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। সামাজিক মৌখিক ভাষা তার ক্রিয়া-কর্ম শেষে যখনই শুধুমাত্র উক্তি হিসেবে অবস্থান নিয়েছে, ঠিক তখনই নতুন আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে নতুন অর্থসহ তৈরি করেছে নতুন এপিস্টেমের। মানুষ, মানুষের জ্ঞান আর ইতিহাস এগুচ্ছে এভাবেই। মিশেল ফুকো তাঁর দর্শনে কিছু মৌলিক সমস্যাকে তুলে ধরলেও কোনো সমাধান দেননি।
আর এ জন্য ফুকোর দর্শনকে অনেকে নৈরাজ্যবাদী বলে চিহ্নিত করতে চান। তবে বর্তমান সময়ের দর্শনে মিশেল ফুকোর চিন্তা-চেতনাকে বারবার আনতেই হবে, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ফুকোর দর্শন এক পৃষ্ঠায় তুলে ধরা সম্ভব নয় (সে ধরনের জ্ঞান ও ভাষা লেখকের নেই)। পাঠক যদি মিশেল ফুকো সম্পর্কে আরও বিস্তারিত জানতে চান তবে ফুকো রচিত অর্ডার অব থিংস, আর্কিওলজি অব নলেজ, বার্থ অব ক্লিনিক, ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট, হিস্টোরি সেক্সুয়ালিটি শিরোনামের বইগুলো পড়ে দেখতে পারেন।