ক্রিকেটখেলামতামতহোমপেজ স্লাইড ছবি
সাকিবের নিষেধাজ্ঞা এবং আমাদের প্রত্যাশা

সাব্বির আহমেদ: সাকিব আল হাসান সম্ভবত ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডার। বিশ্বক্রিকেটের এ ক্ষণজন্মা প্রতিভা আমাদের মানুষ, ভাবলেই মন ভরে যায়। প্রতিভাবানরা কিছুটা একা হয়। তার পৃথিবীতে সে স্বাধীন থাকতে চায়। আমরা একে ঔদ্ধত্য ভাবি। বিরল প্রতিভাবানদের ‘ঔদ্ধত্য’ থাকে। সাকিবেরও আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। “সুবোধ” প্রতিভা খুব বিরল বিষয়।
সাকিবের ‘ঔদ্ধত্য’ অনেকের কাছে অসহ্য ঠেকে। মাঝে মধ্যে নানান ছুতোয় তাকে আক্রমন করা হয়। মি. অলরাউন্ডারের ডিফেন্সে স্ত্রী উম্মে আহমেদ শিশিরকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সময়ে সময়ে লিখতে হয়। তবে সেগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। বিশ্বের অগণিত মানুষ সাকিবকে ভালবাসে। শিশুরা সাকিবের ছবি হাতে নিয়ে ঘুমায়। কিশোরেরা সাকিব হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকে।
আইসিসি সাকিব আল হাসানকে সব রকম ক্রিকেট থেকে দুই বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছে। এর মধ্যে এক বছর হবে সাসপেন্ডেড নিষেধাজ্ঞা, যার মানে প্রকৃত নিষেধাজ্ঞা আসলে এক বছরের।
সাকিবের প্রতি আমাদের ভালোবাসা অন্ধ। এ শাস্তি আমরা কোনোভাবেই মানতে পাচ্ছিনা। সাকিব নিজে দোষ স্বীকার করেছেন, শাস্তি মেনে নিয়েছেন, কিন্তু আমরা তার তেমন বড় দোষ দেখছি না। অনেকে আবার এখানে ষড়যন্ত্র দেখছি। এ দলে অনেক বিজ্ঞজনেরা আছেন।
সাকিবের বিষয়ে তদন্ত করেছে আইসিসির Anti-Corruption Unit (ACU)| বিশ্বের স্পোর্টস নিয়ন্ত্রক এজেন্সিগুলোর মধ্যে প্রফেশনালিজমের দিক থেকে ACU এর বেশ সুখ্যাতি আছে। বৃটিশ পুলিশের খ্যাতিমান কর্মকর্তা স্যার রোনাল্ড ফ্ল্যানাগান এর চেয়ারম্যান। আরেক কর্মকর্তা অ্যালেক্স মার্শালও দীর্ঘদিন পুলিশে কাজ করেছেন বেশ সুনাম নিয়ে। তারা ষড়যন্ত্রের অংশ হবেন, কারো কথায় প্রভাবিত হয়ে কাজ করবেন তা ভাবা যায় না।
ম্যাচ ফিক্সিং আর বাজি ক্রিকেটকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কতো উদীয়মান, প্রতিভাবান ক্রিকেটারের জীবন ধ্বংস করেছে এ সর্বনেশে ভাইরাস! বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির যুগে ম্যাচ ফিক্সিং এর উপর নজরদারী করা সীমাহীন কঠিন কাজ। আইসিসি তাই আম্পায়ার, খেলোয়ার, ম্যানেজার, কিউরেটর – সবার উপর বাধ্যবাধকতা দিয়েছে, ম্যাচ ফিক্সিং বিষয়ক কোনো প্রস্তাব পাওয়ার সাথে সাথে রিপোর্ট করতে হবে। এরূপ রিপোর্টিংয়ের গুরুত্ব অনেক। সাথে সাথে ব্যবস্থা নেয়া যায়, প্রস্তাবকারী দমে যায়, রিপোর্টকারীর ইনটিগ্রিটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়।
দেশী বিদেশী মিডিয়া বলছে, আইসিসির সন্দেহভাজন দীপক আগারওয়াল নভেম্বর ২০১৭ থেকে এপ্রিল ২০১৮ সময়ে কয়েকবার WhattsApp ম্যাসেঞ্জারে সাকিবের সাথে যোগাযোগ করেছে, inside information পাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। আইসিসি অনেক দিন ধরে বিষয়টি তদন্ত করেছে। ACU কর্মকর্তারা সাকিবের সাথে এ বছরে দু’বার কথা বলেছেন: প্রথমবার ২৩ জানুয়ারি আর পরেরবার ২৭ আগস্ট তারিখে। ফলে দেখা যাচ্ছে, এখানে আর কিছু নেই। সাকিব কোড অব কন্ডাক্ট ভেঙেছেন।
সাকিব বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের একজন। সব বিষয়েই তাকে বিশ্বমানের হতে হবে। খেলার মূল্যবোধ মানার ক্ষেত্রেও তিনি highest standard মেনে চলবেন- এমনটি সবাই আশা করে। সাকিব ভুল করলে আর সবার মতো শাস্তি হবে – এ সত্যটা আমাদের মেনে নিতে হবে। সাকিবকে যতই ভালোবাসি, সত্যকে সত্য বলতে হবে। আবেগ যদি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়ার মতো, সত্যকে অস্বীকার করার মতো অন্ধ হয় তাহলে সমাজ পরিণত হবে না। আমাদের জাজমেন্ট ফেয়ার না হলে আমাদের শিশু-কিশোরেরা সমৃদ্ধ বিচার বুদ্ধির প্রজন্ম হিসেবে গড়ে উঠবে না।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাকিব আল হাসান অনেক বড়। লক্ষ লক্ষ শিশু-কিশোর সাকিবকে অনুসরণ করে। বাইরের জগতে দেশের বড় প্রতিনিধি তিনি। আমরা অশেষ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধায় সাকিবকে ভরে রাখি। তাই দেশের মানুষের কাছে তার অনেক ঋণ। দায়িত্বশীল থেকে, অনুকরণীয় থেকে কেবল সে ঋণ শোধ করা যায়। সাকিব কাজটা একদম ঠিক করেননি। সাকিবের ঔদ্ধত্যের সৌন্দর্য আমাকে যেমন মুগ্ধ করে, তার দায়িত্বহীনতা আমাকে তেমনি পীড়া দিয়েছে।
উঁচু আসনের মানুষ আমাদের সমাজে এমনিতে কম। তাই, অল্প কিছু শ্বেত-শুভ্র আইকন যারা আছেন, তাদের গায়ে কালো আচঁড় পড়তে দেখলে খুব কষ্ট হয়।
সাকিবকে ধন্যবাদ, তিনি ভুল স্বীকার করেছেন। শাস্তি মেনে নিয়েছেন। তরুণ খেলোয়াড়দেরকে আইসিসির কোড অব কনডাক্ট মেনে চলার দায়িত্ববোধ শেখানোর অঙ্গীকার করেছেন। সাকিব ভুল থেকে শিক্ষা নিবেন, দারুণভাবে ফিরে আসবেন, উম্মে আহমেদ শিশিরের ভাষায় ‘উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে কিংবদন্তি হবেন’ তা দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।