বই Talkসাহিত্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
সাবির হাকা: যার কবিতা বিবেকের দরজায় ঝাঁকুনি দেয়

সাবির হাকা। ইরানের একজন নির্মাণ শ্রমিক ও কবি। জন্ম ১৯৮৬ সালে। ইরানের পশ্চিম প্রান্তে কারমানশা প্রভিন্সে। এখন থাকেন ইরানের তেহরানে। নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে সেখানে কর্মরত। সাবিরের কবিতা আমাদের বিবেকের দরজায় প্রবল ঝাঁকুনি দেয়। থরথর করে কাঁপিয়ে দেয়। সাবিরের কবিতায় অন্য এক ধূসর পৃথিবীর ছবি— সব দেশের শোষিত নিপীড়িত মজদুর জীবনের প্রায় অনুচ্চারিত কথন, অন্য মাত্রায়, অনন্য গভীরতায়।
সাবির বলেছেন, তেহরানে ঘুমোবার মত তাঁর কোন জায়গা নেই। কখনো সারা রাত হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। অনেকের মত তাঁরও কোন সামাজিক সুরক্ষা নেই। দারিদ্রকে আলাদা করে তাঁকে চিনতে হয়নি। জীবনের গোড়া থেকেই দারিদ্রের বিরুদ্ধে কঠোর সংগ্রাম ছিল, আজও তা অব্যাহত। ইতিমধ্যে দুটি কবিতার বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি প্রতিযোগিতায় ২০১৩ সালে ইরানের শ্রমিক-কবি হিসাবে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেন। একটি সাক্ষাৎকারে সাবির বলেছিলেন, “আমি ক্লান্ত। বড়ই ক্লান্ত।
আমার এই ক্লান্তি আমার জন্মের আগে থেকেই ছিল। আমার মা আমাকে পেটে ধরার সময়ে লাগাতার মজদুরী করেছিলেন। সেই তখন থেকেই আমি মজদুর ব’নে গেছি। আমি আমার মায়ের ক্লান্তি অনুভব করি। মায়ের ক্লান্তি যেন এখনো আমার শরীরে লেগে আছে।” সাবিরের কিছু কবিতা ‘আয়নানগর’ বইমেলা সংখ্যা ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। ‘আয়নানগর’ পত্রিকাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে সাবিরের কিছু কবিতা এখানে তুলে ধরলাম।
❑ তুঁতফল আপনি কি কখনো তুঁতফল দেখেছেন? যেখানে পড়ে, সেইটুকু মাটির ওপর ওর লাল রসের দাগ হয়ে যায় পড়ে যাবার মতো যন্ত্রণাদায়ক আর কিছু নেই আমি কত মজদুরকে দেখেছি বড় বড় ইমারত থেকে পড়ে যেতে আর পড়ে গিয়ে, ঠিক তুঁতফল হয়ে যেতে
❑ সরকার পুলিশ আমাকে খুঁজছে আমি কাউকে খুন করিনি এমনকি সরকারবিরোধী কোনো লেখাও লিখিনি! শুধু তুমি জানো আমার প্রিয়তমা জনতার পক্ষে কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে, যদি সরকার শুধু এই জন্যে ভয় পায় আমাকে যে আমি একজন মজদুর! যদি আমি বিপ্লবী বা বিদ্রোহী হতাম, তাহলে? কি করতো এরা তাহলে? তবুও বলি, সেই বাচ্চাটার জন্যে পৃথিবীটা আজও খুব একটা বদলায়নি যে স্কুলের প্রত্যেকটা বইয়ের প্রচ্ছদে নিজের ছবি দেখতে চেয়েছিল
❑ ঈশ্বর ঈশ্বরও নিশ্চয় একজন মজদুর! ঈশ্বর যেন সর্বশ্রেষ্ঠ ঝালাই মিস্ত্রী গোধূলি-আলোতে ঈশ্বরের চোখ লাল হয়ে ওঠে, যেন জ্বলন্ত কয়লা আর রাত্রি পর্যন্ত শতছিদ্র হয়ে যায় তাঁর জোব্বা!
❑ ঘর তোমরা যদি বলো, সারা দুনিয়াকে আমি ওই নামে ডাকতে পারি দুনিয়ার সব দেশ, সব গ্রামকেও ডাকতে পারি ওই নামে। আর আকাশ? হ্যাঁ তাকেও দিতে পারি ওই নাম! সারা ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত কিছুকে ওই নাম ধরে ডাকতে এক মুহূর্তও দ্বিধা করবো না আমি! কিন্তু দোহাই তোমাদের তেহরানের ভাড়া করা জানালাবিহীন এই কালকুঠরীকে তোমরা ওই নামে ডাকতে বোলো না আমি একে ঘর বলে কিছুতেই ডাকতে পারবো না!
❑ বন্দুক ওরা যদি বন্দুক আবিষ্কার না করতো কত মানুষ বেঁচে থাকতো আজ! যাদেরকে দূর থেকেই মেরে ফেলতে পারলো ওরা! শুধু তাই নয়, আমার মনে হয় আরও অনেককিছুই অনেক সহজ হতো। মজদুরের যে আসলে কতটা শক্তি তাও ওদেরকে বোঝানো সহজ হতো যদি বন্দুকের আবিষ্কার না হতো
❑ কেরিয়ার নির্বাচন ব্যাঙ্কের সাধারণ একজন কর্মচারি হওয়া আমার দ্বারা হত না খাবার দাবার ফেরি করা সেলসম্যানও না কোন পার্টির নেতা হওয়াও আমার কম্ম নয় ট্যাক্সি ড্রাইভার তো নয়ই প্রচারে লেগে থাকা মার্কেটিংএর বান্দাও আমি নই আমি শুধু চাইতাম শহরের সবথেকে উঁচু জায়গাটায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখব নিচের ঝলমলে বাড়িগুলোর মধ্যে কেমন দেখায় ওই মেয়ের ঘর যাকে আমি ভালবেসেছি তাই শেষমেশ ঢালাইয়ের মজদুর হয়ে গেলাম
❑ আমার বাবা বাবার ব্যাপারে কিছু বলার সাহস যদি করে উঠতে পারি তাহলে বিশ্বাস করুন, বাবার জীবনে আনন্দ বলে কখনোই তেমন কিছু ছিল না এই লোকের জীবন নিজের পরিবারের জন্য নিবেদিত ছিল পরিবারের ঘাটতি যাতে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকে সেজন্য নিজের জীবনকে কঠিন, বন্ধুর বানাতে দ্বিধা করেননি তিনি আর আজ যখন আমার কবিতা ছাপা হয়ে বেরোয় শুধু একটা কথা ভাবলেই মাথা হেঁট হয়ে যায় লজ্জায়— বাবা আমার পড়তে পারেন না।
❑ আস্থা আমার বাবা শ্রমিক ছিলেন আস্থাবান, নিষ্ঠাবান শ্রমিক যখনি উনি নামাজ পড়তে বসতেন (আল্লাহ) ওঁর হাতদুটো দেখে লজ্জিত হতেন
❑ মৃত্যু এক রাতে মা বলল সে নাকি জানে মৃত্যুকে কেমন দেখতে তার নাকি ইয়াব্বড় ঘন গোঁফ আর চওড়া সুগঠিত কাঁধ, যেন কোন বডিবিল্ডার সেই রাত থেকে আমার নিষ্পাপ নিরীহ মাকে আমি সন্দেহের চোখে দেখি
❑ বন্ধুত্ব আমার সাথে (ঈশ্বরের) বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি তার কারণ একটাই বহুদিন আগে ঘটা একটা ঘটনা; তখন আমাদের ছয় জনের পরিবার একটা ছোট্ট কামরায় কোনমতে চাপাচাপি করে থাকতো অথচ (ঈশ্বর) থাকত একটা বিশাল বাড়িতে একেবারে একা।
❑ বর্ডার কাফন যেমন লাশকে ঢেকে রাখে বরফও অনেক কিছুকে ঢেকে দেয়। ইট কাঠের কংকাল বেরিয়ে পড়া বাড়ি, গাছ, কবর সবকিছুকেই সাদা চাদরে ঢেকে দেয় বরফ শুধু বরফই পারে দুনিয়ার সকল বর্ডারকে সাদা রঙে রাঙিয়ে দিতে।
❑ একমাত্র ভয় যখন আমি মারা যাবো সঙ্গে নিজের সব প্রিয় বই নিয়ে যাবো আমি আমার কবর-বাড়ি ভরে দেব তাদের ছবি দিয়ে যাদের আমি সীমাহীন ভালোবাসি। ভবিষ্যতের কোনো দুশ্চিন্তাই আমার সেই নতুন বাড়িতে থাকতে পাবে না! আমি শুয়ে থাকবো বেফিকির, সিগারেটের পর সিগারেট জ্বালাবো আর ফুঁপিয়ে উঠবো তাদের কথা ভেবে যে সব মেয়েদের আমি কখনো ভালোবেসেছিলাম আর যাদের জড়িয়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছিলাম! এই সমস্ত সুন্দর ভাবনার ভেতরেও শুধু একটা মাত্র ভয় থেকে যাবে কোথাও যদি কোনো এক দিন, ভোর না হতেই কেউ আমার কাঁধে ধাক্কা দিয়ে উঠিয়ে আমায় আবার বলে “চল রে সাবির! কাজে বেরোতে হবে!”
□ বাংলায় অনুবাদ: অঙ্কিতা, নয়না।