বিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
সিনেমার মহারাজা, তোমারে সেলাম!

সাবা তারান্নুম: বাঙালীর ছেলে অথচ এই গুণী মানুষটির সিনেমা দেখেনি কিংবা তার বই পড়ে কৈশোর কাটায়নি এমনটা পাওয়া মুশকিল। তার হাতেই চলচ্চিত্রে উপমহাদেশের প্রথম অস্কার অর্জন। যাকে উদ্দেশ্য করে বিখ্যাত জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক আকিরা কুরোসাওয়া বলেছিলেন,”সত্যজিৎ রায়ের সিনেমা যে দেখেনি,সে পৃথিবীতে বাস করে চন্দ্র-সূর্যও দেখেনি”। হ্যাঁ, তিনিই সেই কিংবদন্তী সত্যজিৎ রায়, যার অমরত্ব ঘটেছে বাংলা সিনেমার প্রাণপুরুষ হিসেবে। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটির পৈতৃক নিবাস বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জে। জন্মগ্রহণ করেন শিক্ষা ও সাহিত্যে অনন্য কলকাতার বিখ্যাত রায়চৌধুরী পরিবারে। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন একাধারে লেখক প্রকাশক ও চিত্রকর।
ছন্দের জাদুকর এবং বাংলায় ননসেন্স কবিতার প্রবর্তক সুকুমার রায় এর একমাত্র ছেলে সত্যজিৎ রায়। প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে পড়াশোনা করলেও পরবর্তিতে সত্যজিৎ কর্মজীবন শুরু করেন বিজ্ঞাপন সংস্থার ভিজ্যুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে। সেসময় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বিখ্যাত উপন্যাস “পথের পাঁচালী”র প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ করতে করতে সেই ছবিগুলোই একসময় হয়ে ওঠে তার সাড়া জাগানো চলচ্চিত্র “পথের পাঁচালী”র দৃশ্য। ১৯৪৮ সালে কয়েক মাসের জন্য ইংল্যান্ডে যান সত্যজিৎ রায়, তখন ইউরোপ-আমেরিকার সিনেমা দেখার সুযোগ হয়। সেসময় ফরাসী চলচ্চিত্রকার জাঁ রেনোয়ার তার ‘দ্য রিভার’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের কাজে কলকাতা আসলে সাক্ষাত হয় সত্যজিৎ-এর সাথে।
যিনি তাকে সিনেমা নির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেন। ইতালির একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র “বাইসাইকেল থিফ” সিনেমাটি দেখে সত্যজিৎ রায় জীবনধর্মী সিনেমা নির্মাণে উৎসাহী হয়ে সাধারণ কিছু অভিনেতা অভিনেত্রী নিয়ে শুরু করেন ‘পথের পাঁচালী’র শ্যুটিং। অর্থের অভাবে মাঝপথে বন্ধ হয়ে যাওয়া সিনেমার কাজ পুনরায় শুরু করার জন্য বিক্রি করে দেন নিজের দামী বইপত্র বন্ধক রাখেন স্ত্রীর গহনাও। মুক্তির পর তৎকালীন কলকাতারা দর্শকেরা প্রথম এর মর্মার্থ বুঝতে না পারলেও বছর ঘুরতেই কান চলচ্চিত্র উৎসবে “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” শাখায় পুরষ্কারসহ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরষ্কার অর্জন করে এই সিনেমা। এরপর এই গুণী মানুষটিকে আর থামতে হয়নি। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে একে একে নির্মাণ করেন ‘অপরাজিত’ ও ‘অপুর সংসার’। এই তিনটি সিনেমাকে একসাথে বলা হলো অপুত্রয়ী বা অপু ট্রীলজি। সাহিত্য নির্ভর সিনেমা নির্মাণে সত্যজিৎ রায়ের জুড়ি মেলা ভার।
উপন্যাস কিংবা ছোটগল্পের অনুকরণে এতো অপূর্ব সিনেমা তৈরি করা সম্ভব তা ভালোভাবেই দেখিয়ে দিয়েছেন সত্যজিৎ। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় এর ‘দেবী’, রাজশেখর বসুর ‘পরশপাথর’, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় এর ‘জলসাঘর’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’(চারুলতা) ও ‘ঘরে বাইরে’, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রী’ ও ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, হেনরিক ইবসনের ‘গণশত্রু’(এন এনিমি অব দ্যা পিপল), শংকরের ‘জনঅরণ্য’ এবং শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘চিড়িয়াখানা’। পিতামহ উপেন্দ্রকিশোরের রায়চৌধুরীর অসামান্য সৃষ্টি ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’ অবলম্বনে নির্মিত সম্পূর্ণ ভিন্নধারার মুভি গুপি-বাঘা ট্রিলজি (গুপি গায়েন বাঘা বায়েন, হীরক রাজার দেশে, গুপী-বাঘা ফিরে এলো)। এর প্রথম দুটি সিনেমা তখন যেমন ব্লকবাস্টার হিট হয়েছিলো আজো তেমনি জনপ্রিয়। সত্যজিৎ এর আরো একটি অসামান্য সৃষ্টি হল তার নিজের সৃষ্ট গোয়েন্দা চরিত্র ‘ফেলুদা’(সোনার কেল্লা ও জয়বাবা ফেলুনাথ) থেকে নির্মিত সিনেমা।
সত্যজিৎ রায়ের মুন্সীয়ানা হিন্দী মুভিতেও কম নয়। ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ তার মধ্যে অন্যতম। পন্ডিত রবি শঙ্করের সঙ্গীত তার সিনেমায় দিয়েছিলো অনন্য মাত্রা। পরবর্তী সিনেমাগুলোর সঙ্গীত পরিচালনা করে সঙ্গীতাঙ্গনেও সত্যজিৎ নিজের ছাপ রেখে গেছেন। রীতিমতো এক নতুন ধারার সুর তার সঙ্গীতকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে। মৃত্যুর মাত্র ২৩ দিন আগে সত্যজিৎ রায় অর্জন করেন তার জীবনের শ্রেষ্টতম পুরষ্কারটি-অস্কার। এছাড়াও তিনি ভারত সরকারের নিকট থেকে ৪০টি পুরস্কার এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ৬০টি পুরস্কার লাভ করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে দেশ-বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রি, বিশ্বভারতীর ‘দেশিকোত্তম’, ‘দাদা সাহেব ফালকে’ পুরস্কার, ‘ম্যাগসেসেই পুরস্কার’, ফ্রান্সের ‘লিজিয়ন অব অনার’ (১৯৮৭), ‘ভারতরত্ন’ (১৯৯২) ইত্যাদি। আজ এই সিনেমার মহারাজার জন্মদিন।
সত্যজিৎ রায় বাংলার শিল্পাঙ্গনে এমনই একজন ব্যক্তিত্ব যিনি তার কাজের মধ্যে দিয়ে হয়েছেন অমৃতলোকের বাসিন্দা। কালজয়ী এই চলচ্চিত্র দিকপালের জন্য রইলো গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলী।