বিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
সিনেমা হলের অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত

মাহমুদুর রহমান: সিনেমা মানুষের জীবনের দর্পণ। তবে তাতে কিছুটা মসলা, রঙ মিশিয়ে উপস্থাপন করা সব সময়েরই রীতি। বিংশ শতকের শুরুতে শুরু হওয়া নির্বাক চলচ্চিত্র একদিন সবাক হলো এবং একে একেক পৃথিবীর সব দেশে ছড়িয়ে পড়লো চলচ্চিত্র বা সিনেমা। আর সব দেশেই তার জয়জয়কার। বিংশ শতাব্দীর বিনোদনের অন্যতম হাতিয়ার বা মাধ্যম সিনেমা।
এবং এই সিনেমা যেখানে প্রদর্শিত হতো, তাই সিনেমা হল। মূলত টেলিভিশনের প্রচার ও প্রসার হওয়ার পূর্বে মানুষ সিনেমা হলে গিয়েই সিনেমা দেখত। টেলিভিশন আসার পরেও তেমন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু স্যাটেলাইটের কল্যাণে অসংখ্য চ্যানেল এবং অসংখ্য সিনেমা ড্রইং রুমে চলে আসার কারণে ধীরে ধীরে সিনেমা হলের প্রতি মানুষের আগ্রহ কমতে থাকে।
একটা সময় ঢাকা শহরে সিনেমা হলের সামনে টিকেটের জন্য লাইন দিতে হতো। রাজ্জাক, ববিতা, আলমগির, শাবানাদের সিনেমা এলে লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়তো। এ তো বেশীদিন আগের কথা না। তিরিশ চল্লিশ বছর আগেও এমন দৃশ্য দেখা যেতো। এমনকি তারও আগে সিনেমা হল রীতিমত শুদ্ধ সংস্কৃতির চর্চার জায়গা ছিল। কেবল ঢাকা নয়, সিনেমার আবেদনে ঢাকার বাইরেও গড়ে উঠেছিল অনেক সিনেমা হল। এবং এই হল ঘিরে ছিল অনেক মানুষের জীবিকার সংস্থান।
একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এসে সিনেমা হলে মানুষের আনাগোনা একদম কমে গেলো। এমনকি মানুষের মনোযোগ টানতে এই শতাব্দীর শুরুর দশকে ঢাকা, গাজীপুর সহ অনেক নামি সিনেমা হলেও অশ্লীল চলচ্চিত্র দেখানো হতো। দেশি সিনেমার মাঝে বিদেশি অশ্লীল দৃশ্য ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল নিত্য ব্যপার। পরবর্তীতে এ নিয়ে প্রতিবাদ হওয়ায় তা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সিনেমা হলে দর্শক আগমন ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যায়।
সিনেমা হলে দর্শক না আসা অন্যতম কারন আমাদের দেশের সিনেমার নিম্নমান। সেই সঙ্গে স্যাটেলাইটের কল্যাণে বিদেশি ভালো চলচ্চিত্র দেখে দর্শক এখন আর এসব সিনেমা দেখতে চায় না। সিনেমার কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের সিনেমার মানের দিকে নজর না দিয়ে বিদেশি সিনেমা ব্যান করার তালে আছেন। সেই সঙ্গে পুরনো সিনেমা হলে আধুনিক প্রযুক্তি না থাকার কারণে মানুষ সেদিকে ফিরে তাকায় না।
এসব কারণে দেশজুড়ে একের পর এক সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সেই মিছিলে গত বছর যোগ দিয়েছে আরও ৮০টি সিনেমা হল। এর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী আজাদ, রাজমণি, মধুমিতা, জোনাকী, অভিসার ও মুক্তি। নারায়ণগঞ্জের চলন্তিকা, চট্টগ্রামের আলমাস, রাজশাহীর উপহার। বেশ কিছু সিনেমা হল ভেঙে মালিকেরা বিপণি বিতান তৈরির পরিকল্পনা করেছেন।
মাত্র ১০ বছর আগেও সারা দেশে সিনেমা হলের সঙ্গে প্রায় ৪৮ হাজার কর্মী জড়িত ছিলেন। এখন কর্মী সংখ্যা কমে পাঁচ হাজারের নিচে নেমে গেছে। যেসব সিনেমা হল টিকে আছে, বেতন দিতে না পারায় সেগুলোতেও লোকবল কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের শুরুতে সারা দেশে সিনেমা হল ছিল ১ হাজার ৪৩৫টি। এরপর থেকে হলের সংখ্যা কমতে কমতে ২০১৭ সালে দাঁড়ায় ২২০টি।
এ চিত্র কেবল বাংলাদেশের নয়? কলকাতায়ও একটা সময়ে প্রচুর সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সিনেমা পাগল মানুষদের উপজীব্য করে কলকাতার বিখ্যাত পরিচালক কৌশিক গাঙ্গুলি ‘সিনেমাওয়ালা’ নামে একটি চলচচ্চিত্র নির্মাণ করেন ২০১৬ সালে। সিনেমা হল এবং সিনেমার দুরবস্থা ফুটে উঠেছে এখানে।
আমাদের দেশে গত দুই তিন বছরে বেশকিছু সিনেমা ভালো হয়েছে এবং দর্শক আগ্রহ দেখিয়েছে। এখন ভালো সিনেমার পাশাপাশি সিনেমা হলের সংস্কার, আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন করতে পারলে হয়ত সিনেমা হলে দর্শক ফিরবে। নইলে একে একে বন্ধ হবে সব সিনেমা হল। হারিয়ে যাবে ঐতিহ্য।