
মাহমুদুর রহমান: হারিয়ে যাওয়ার মিছিলে সামিল হলো আরেকটি নাম, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। ছিন্নমূল মানুষের হাহাকার আর জীবনের গল্প বলা মানুষটি ৮৫ বছর বয়সে ঈশ্বরের বাগানে পৌঁছে গেলেন।
সু-সাহিত্যিক অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে। জন্মস্থান বর্তমান বাংলাদেশের ঢাকায়। ছেলেবেলা কেটেছে এখানেই। পড়াশোনা করেছিলেন সোনারগাঁও পানাম স্কুলে। অন্যান্য অনেকের মতোই দেশভাগের পর তাকেও চলে যেতে হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে। পেয়েছিলেন ‘বাঙাল’ তকমা।
পশ্চিমবঙ্গ থেকেই তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষা লাভ। ১৯৫৬ সালে তিনি বানিজ্য বিভাগে স্নাতক হন। পরবর্তীতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিচার্স ট্রেনিং ডিগ্রি লাভ করেন। কর্মজীবনে বহু ধরনের কাজ করেছে তিনি। ট্রাক পরিষ্কারের কাজ করেছেন এক সময়, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। পরবর্তীতে সিনিয়র বেসিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন। মুর্শিদাবাদের সাতুই রাজেন্দ্র নারায়ণ হাই স্কুলেও শিক্ষকতা করেছেন অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৮৬ সালে পাকাপাকিভাবে কলকাতায় বাস শুরু করেন। পরবর্তীতে সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেছেন বেশ কিছুদিন।
লেখালেখির সূচনা বলতে গেলে, তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ‘অবসর’ পত্রিকায়, যা বহরমপুর থেকে প্রকাশিত হতো। এরপর লিখে চলেন একটু একটু করে এবং একসময় হাত খুলে লেখেন অতীন বাবু।
বাংলা সাহিত্যে তিনি বেশকিছু চমৎকার কাজ উপহার দিয়েছেন। তাঁর চারটি বই অত্যন্ত বিখ্যাত। ‘নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজে’, ‘অলৌকিক জলযান’, ‘ঈশ্বরের বাগান’ ও ‘মানুষের ঘরবাড়ি’। এ উপন্যাসগুলো পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। প্রতিটি উপন্যাসে বিধৃত হয়েছে ছিন্নমূল মানুষের জীবনের গল্প।
মূলত অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সাহিত্য সাধনার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ হতে। অতীনের সবচেয়ে বিখ্যাত বইয়ের নামের দিকে তাকালেও তা বোঝা যায়। বাবার সাথে অপুর নীলকণ্ঠ পাখির খোঁজ তাঁর মনে গেঁথে ছিল।
অতীন বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ছিলেন বাস্তুহারা। তাই বাস্তুহারা মানুষের দুঃখ তিনি জানতেন। সে দুঃখ, জীবন আর জীবনবোধকে তিনি কলমের আচরে অক্ষরে চিত্রিত করেছিলেন। এ চারটি বইয়ের বাইরেও তাঁর আরও অনেক গ্রন্থ পাঠক মহলে আদৃত হয়েছে। ‘দেবী মহিমা’, ‘দ্বিতীয় পুরুষ, ‘মানুষের হাহাকার’, ‘দুঃস্বপ্ন’, ‘উপেক্ষা’, ‘ঋতুসংহার’, ‘নগ্ন ঈশ্বর’, ‘নীল তিমি’, ‘একটি জলের রেখা’ সহ তাঁর একাধিক লেখা সুপাঠ্য।
সাহিত্য সাধনার স্বীকৃতি হিসেবে তিনি অনেক পুরষ্কারেও ভূষিত হয়েছেন। ১৯৫৮ সালে ‘সমুদ্র মানুষ’ এর জন্য মানিক স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৯১ সালে বিভূতিভূষণ স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৯৩ সালে পঞ্চযোগিনী-র জন্য ভুয়াল্কা পুরস্কার। ‘দুই ভারতবর্ষ’-র জন্য ১৯৯৮ সালে বঙ্কিম পুরস্কার লাভ করেন। উপন্যাসের পাশাপাশি তিনি গল্প লেখায় সমান দক্ষ ছিলেন। তাঁর ‘পঞ্চাশটি গল্প’-র জন্য ২০০১ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন।
কিন্তু একজন লেখকের আসল পুরস্কার পাঠকের হৃদয়ে স্থান পাওয়া। তিনি তা পেয়েছেন। গত ১৯ জানুয়ারি তিনি নিজ পুত্রের হাতে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় অন্যলোকে গমন করলেও তিনি তাঁর পাঠকের হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।