বাক্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প সত্যি নাকি রূপকথা?

আরিফুল আলম জুয়েল: ছোটবেলায় হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার গল্প শুনেনি বা পড়েনি এমন কাউকে ই খুঁজে পাওয়া যাবে না! তবে কোনো এক কারণে আমরা সব সময় শহরের নামটা ‘হ্যামিলন’ পড়েছি, আসলে নামটা হবে ‘হ্যামেলিন’! হয়তো ভাবছেন রুপকথার গল্পে শহরের নামে কিবা এসে যায়! গল্পটাকে রুপকথার গল্প মনে হলেও আসলে তা নয়! আমি নিজেও জানতাম না ঘটনাটা, যখন সত্য ঘটনা হিসেবে পড়লাম তখন ভিড়মি খেলাম, কিঞ্চিৎ আপনিও হয়তো খাবেন! বাস্তবেই জার্মানিতে ঘটে যাওয়া এক ঘটনা থেকেই উৎপত্তি ঘটে এই গল্পটির। কী সেই ঘটনা?
জার্মানির লোয়ার স্যাক্সনি প্রদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ওয়েসার নদীর তীরে অবস্থিত হ্যামেলিন শহর। সালটা ছিল ঠিক ১২৮৪।
হ্যামেলিন শহর তখন ইঁদুরের প্রকোপের স্বীকার। এখানে সেখানে যত্রতত্র ইঁদুর পাওয়া যাচ্ছে। ঘরে, বাইরে, স্কুলে, অফিসে কোথাও রেহাই নেই, সর্বত্র ইঁদুরের যন্ত্রণা।
হঠাৎ একদিন কোথা থেকে যেন এসে হাজির এক বাঁশিওয়ালা; তার গায়ে ছিল হরেক রঙের পোশাক। সে এক উপায় বাতলে দিল হ্যামেলিনের মেয়রের কাছে। বললো, সে চাইলে শহরের সব ইঁদুর দূর করে দিতে পারবে! মেয়র সাহেব বললেন, ঠিক আছে, ইঁদুর তাড়িয়ে দাও, তাহলে তোমাকে আমি ১০০০ সোনার মুদ্রা দেব। বাঁশিওয়ালা রাজি হয়ে গেল, তার বাঁশি বাজালো আর সুড় সুড় করে সবগুলো ইঁদুর পেছন পেছন এসে তলিয়ে গেল শহরের পাশের ওয়েসার নদীর জলে। তবে একটা ইঁদুর বেঁচে গেল কীভাবে যেন! বাঁশিওয়ালা ফিরে এলো, তার প্রাপ্য চাইলো। কিন্তু মেয়র তাকে ১০০০ সোনার মুদ্রা দিতে চাইলেন না, দিলেন মাত্র ৫০! সাথে আরো বলে বসলেন, বাঁশিওয়ালা নিজেই এই ইঁদুরগুলো এনেছিল যেন তাড়িয়ে টাকা আয় করতে পারে!
বাঁশিওয়ালা চলে গেল রেগে, যাবার আগে বলে গেল প্রতিশোধ নিয়ে ছাড়বে। এরপর আসলো ১২৮৪ সালের জুন মাসের ২৬ তারিখ, বাঁশিওয়ালার প্রতিশোধ নেয়ার দিন! সেদিন শহরে ফিস্ট চলছিল, রোমে জন এবং পলের শহীদ হবার স্মরণে সেন্ট জন-পল দিবস পালন করা হয়। সবাই ছিল চার্চে, যখন বাঁশিওয়ালা ফিরে এলো, তবে এবার মোটেও রঙ বেরঙের পোশাকে নয়, একরঙা সবুজ পোশাকে। সবুজ মানে ছিল শিকারি!
তখন বাজে সকাল সাতটা। সে বাজানো শুরু করল তার মায়াবী বাঁশি। এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটলো; শহরের সব চার বছরের বড় শিশু বেরিয়ে এলো, গুণে গুণে ১৩০ জন শিশু। সেই শিশুদের মধ্যে মেয়রের মেয়েও ছিল! বাঁশিওয়ালার বাঁশির সুরে শিশুগুলো সম্মোহিত হয়ে এক পাহাড়ের ওপাশের গুহায় ঢুকে গেল, আর কোনদিন বেরিয়ে এলো না। তিন জন শিশু বেঁচে গিয়েছিল। একজন কানে শুনতে পেত না, তাই সুর শোনেনি। আর অন্যজন অন্ধ হয়ে জন্মাবার কারণে দেখতে পায়নি কোথায় যেতে হবে। আরেকজন জ্যাকেট ফেলে গিয়েছিল বলে আবার ফেরত আসে, জ্যাকেট নিয়ে আবার গিয়ে দেখে সবাই চলে গেছে। এই তিন শিশুর মাধ্যমেই চার্চফেরত প্রাপ্তবয়স্করা পরে জানতে পারল কী হয়েছে।
হয়ত আপনি ভাবছেন, এ তো নিছক এক গল্প! কিন্তু না! হ্যামেলিনে একটি জাদুঘর রয়েছে। ওই জাদুঘরে সঞ্চিত অনেক বইয়ের মধ্যে পঞ্চদশ শতাব্দীতে লেখা কয়েকটি বইয়ে পাওয়া যায় এই রহস্যময় কাহিনী। সেখানে পাওয়া যায় এক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ। ফ্রাউ ভন লিউড নামের এক ১৩ বছরের বালিকার ১২৯৪ সালের রেকর্ডে লিপিবদ্ধ আছে যে সুদর্শন এ লোকটির বয়স ছিল আনুমানিক ৩০। তার বাঁশিটি ছিল রুপোর তৈরি।
কি বলবেন এখন আপনি? আরো প্রমাণ চান, ১২৮৪ সালের ঘটনার পরেই চার্চে Stained-glass জানালা লাগানো হয় ১৩০০ সালের দিকে। সেখানে এই করুণ ঘটনা লেখা ছিল। জানালাটা বানাবার উদ্দেশ্যই ছিল শিশুদের স্মরণ করা। জানালাটা ধ্বংস হয়ে যায় ১৬৬০ সালে, পরে ইতিহাসবিদ হ্যান্স ডবারটিন ঐতিহাসিক লেখনী থেকে এই জানালা পুনঃনির্মাণ করেন।
সেখানে দেখা যায় বাঁশিওয়ালা আর সাদা পোশাকে শিশুদের ছবি! বর্তমানের হ্যামেলিন শহরে যদি কখনো বেড়াতে যান তবে দেখবেন সেখানে বাঁশিওয়ালার মূর্তি, সাথে ইঁদুর। ২০০৯ সালে জার্মানিরা এক টুরিস্ট ফেস্ট আয়োজন করে শিশুদের প্রস্থানের করুণ ঘটনার ৭২৫তম বার্ষিকীতে। যে বাড়িতে খোদাই করা ছিল ইতিহাসটি, সেটিকে এখন “র্যাট ক্যাচার” এর বাড়ি বলে। প্রতি বছর ২৬ জুন পালন করা হয় র্যাট ক্যাচার দিবস।
যে রাস্তায় শিশুদের শেষ দেখা গিয়েছিল, সে রাস্তার নাম করা হয়েছে Bungelosenstrasse বা ‘নো ড্রাম স্ট্রিট’ যেখানে এখনো কোনো মিউজিক বাজানো নিষিদ্ধ! মানে জার্মানির যে রাস্তা থেকে শিশুরা উধাও হয়ে গেছে সেখানে এখানেও বাধ্য বাজনা নিষিদ্ধ, আজকে প্রায় ৮০০ বছর ধরে চলছে এই নিষেধাজ্ঞা।
আমাদেরও এমন একজন বাঁশিওয়ালা দরকার, যিনি ইঁদুর নয়, বাঁশির সুর দিয়ে সব জঞ্জাল-অন্যায়-দুর্নীতি-অমানবিকতা-সাম্প্রদায়িকতা কে নদীতে ছুঁড়ে ফেলবেন!