বিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
আলফা: তৃতীয় বিশ্বের পরাবাস্তব এক গল্প

হৃদয় সাহা: মাঝরাতে ঢাকা শহরের রাস্তায় গাধার পিঠে করে নিয়ে যাচ্ছে এক বেওয়ারিশ লাশকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক আর্টিস্ট, সঙ্গে এক বৃহন্নলা। আর পিছনে ডোমেরা নেচে- গেয়ে আসছে। তারপর বিশাল নদীর মাঝখানে লাশটাকে ভাসিয়ে দেয়া হয়। এটা সিনেমার শেষদৃশ্য। শুরুতে দেখা যায়, ঢাকা মহররমের মিছিলে এক শিশু হারিয়ে যায়। এক সিনেমার পোস্টার বয় তাকে খুঁজে পেয়ে লালন-পালন করে, নাম রাখে ‘আলফা’। বড় হয়ে সেই আলফা নিজেও আঁকার জগতে ঢুকে পড়ে,সবাই তাকে চিনে ‘আর্টিস্ট’ নামে।
তবে যুগ বদলেছে,ডিজিটালের এই সময়ে গ্রাফিক্সের সহায়তায় এখন বেশ সহজেই পোস্টার তৈরী করা যায়। তাই আলফা মূলত রিকশার প্লেটে ছবি আঁকে। এছাড়া রাত জেগে, কল্পনা থেকে সে আঁকে এক অর্ধনারীশ্বরের ছবি(যেটা এই সিনেমাকে অন্যরকম পূর্ণতা দিয়েছে) সে থাকে ঝিলের মাঝে এক মাচাঘরে। সেখানে খাবারের সাপ্লাই দেয় এক ডিজিটাল প্রিন্ট-পোস্টার শ্রমিকের বউ। আলফার সাথে তার পরকীয়া, ফলে তার ঔরসে সেই মেয়েটি গর্ভবতী হয়। আবার গার্মেন্টসে কাজ করা অন্য এক মেয়ের সাথেও রয়েছে আলফার ভালোবাসা। নদী এবং নদীতীরবর্তী এই সমাজে আরও আছে এক বৃহন্নলা ও তাদের পালক সন্তানরা, এক অন্ধ বৃদ্ধ দোকানদার আরো অনেকে।
একরাতে নদীতে ভাসতে ভাসতে আলফার মাচাঘরের খুঁটিতে এসে বাঁধে এক বেওয়ারিশ লাশ। আলফা ঠেলে দূরে পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু লাশ ঘুরেফিরে এসে বারবার তার মাচাঘরের খুঁটিতে আটকে থাকে। এদিকে আলফার প্রেয়সী গার্মেন্টসের শ্রমিক মেয়েটি এক কারখানা অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে মারা যায়। আর দেশে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের ফলে ব্লগার হত্যাকান্ড , আগুন সন্ত্রাস, হেফাজতে ইসলামের কর্মকান্ড ইত্যাদি ঘটতে থাকে। আবার অন্যদিকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আলফা পোস্টার শ্রমিকের বৌয়ের গর্ভে নিজ সন্তান থাকার বিষয়টি কেন যেনো এড়িয়ে যেতে থাকে। ক্রমে মাচাঘরের খুঁটিতে ঠেকা লাশের সঙ্গে আলফার আলাপ জমে ওঠে। জানতে পারে লাশের নাম সোলেয়মান। লাশ তাঁর র কাছে আবেদন করে তার পরিবারকে যেন জানানো হয় তার মৃত্যুর ব্যাপারে। আলফা সে চেষ্টা করে, কিন্তু আবেগ সামলাতে না পেরে ব্যর্থ হয়।
পরিশেষে দেখা যায় বেওয়ারিশ লাশটিকে সে খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশে জলে ভাসিয়ে দেয়। সিনেমার নাম আলফা,প্রধান চরিত্রে আলমগীর কবির বেশ ভালো করেছেন, চরিত্রটাও অভিনব। পাশাপাশি বৃহন্নলা চরিত্রে নজর কেড়েছেন মোস্তফা নূর ইসলাম, বাংলাদেশের সিনেমায় এইভাবে বৃহন্নলা চরিত্রটিকে আর কেউ ফুটিয়ে তুলেনি। দুইজনেই জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার মত অভিনয় করেছেন, এছাড়া স্বল্প সময়ে এটিএম শামসুজ্জামান আবার বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি ঠিক কত বড় মাপের অভিনেতা। চিত্রগ্রাহকের কাজ দারুন, সম্পাদনায় ছিলেন ক্যাথরিন মাসুদ। সংক্ষিপ্ত আকারে গানগুলো মনে আরাম দেয়।
আমাদের দেশীয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে এই ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে সিনেমা বানানো অবশ্যই ব্যতিক্রমী আয়োজন, এই সিনেমা দর্শকদের ভাবাবে। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুকে এই সিনেমা বানানোর জন্য কৃতজ্ঞতা, স্যালুট রইলো আপনার জন্য। আজ হয়তো এই সিনেমা নিয়ে তেমন আলোচনা হচ্ছে না, প্রযোজনা সংস্থাও নীরবে মুক্তি দিয়েছে। তবে বহু বছর পর হলেও সত্যিকারের সিনেমাপ্রেমীদের কাছে এই সিনেমা বহুল আলোচ্য বিষয় হবে। সৃজনশীল ভাবনায় নানান প্রতিকী এসেছে এই সিনেমায়। চিত্রনাট্য কিছুটা ধীরগতির হলেও শেষের দিকে একটা বড় অসঙ্গতি ধরা পড়ে, যেটা এই সুন্দর, অভিনব সিনেমার মান কে ক্ষুন্ন করে। নির্মাতার উদ্দেশ্য ভালো, মানবধর্মের বার্তা দিয়েছেন। তবে আরো সচেতন হওয়া জরুরী ছিল।