ছুটিহোমপেজ স্লাইড ছবি
এক বিস্ময়কর গ্রামের গল্প

আরিফুল আলম জুয়েল: আমরা টাকা খরচ করে সময় নিয়ে মেঘ, সমুদ্র, নদী, আকাশ, পাহাড়, মরুভূমি, বাগান, বৃষ্টি, রিসোর্ট, এমিউজমেন্ট পার্ক দেখে বেড়াই দেশের এ প্রান্ত হতে ওপ্রান্ত পর্যন্ত! দেখে আনন্দ নেই, পুলকিত হই আবার বেড়াতে যাওয়ার প্লান করি। কিন্তু আপনি কি কখনো গ্রাম দেখতে গিয়েছেন গাঁটের টাকা খরচ করে সুদূর নাটোর জেলার সিংড়া উপজেলায়। আমি নিশ্চিত যাননি, অনেকেই হয়তো ঐদিকে গিয়েছেন বলে গ্রামটি দেখেছেন কিংবা ঐদিককার যারা আছেন তারা তো জানেনই গ্রামটির কথা!
এবার বলবো বিস্ময়কর সেই গ্রাম হুলহুলিয়ার কথা। জ্বি, ভুল দেখেননি গ্রামের নামই হচ্ছে হুলহুলিয়া। এ গ্রামের বিশেষত্ব কি, আপনাদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন? একটি উদাহরণ দেই, গত দুশো মানে ২০০ বছরে গ্রামটিতে কোন পুলিশ ঢুকেনি, মানে ঢুকার প্রয়োজন পড়েনি এবং গ্রামটির অবস্থান আমাদের দেশেই। ভাবা যায়! আসলে আমরা চাইলে সবই পারি, আমরা যে কবে চাইবো সেটাই বিষয়। আমরা নিজের ভাইয়ের বিরুদ্ধে গিয়ে আদালতে দাঁড়াই, মা-বাবার বিরুদ্ধে মামলা করি, সামান্য ক’টা টাকার জন্য আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধবদের মেরে ফেলি, নিজের বিকৃত পশুত্ব চরিতার্থ করার জন্য বাচ্চা মেয়েকে রেপ করি, সস্তা এমবি কিনে চাঁদে মানুষ দেখা গেছে ভাইরাল করি আরো কত কিছু। সত্যিকার অর্থে আমাদের জন্যই তো আসলে পুলিশ দরকার!
আচ্ছা, এবার ফিরে আসি হুলহুলিয়া গ্রামে! নাটোরের সিংড়া উপজেলার হুলহুলিয়া গ্রাম এর আয়তন ৫২৮ দশমিক ৪৬ কি.মি. বা (২০৪ দশমিক ০৪ বর্গমাইল)। জনসংখ্যা সাড়ে তিন হাজার। গত দু’শ বছর ধরে নিজস্ব গণতান্ত্রিক শাসন আর বিচার ব্যবস্থা দিয়ে পরিচালিত হচ্ছে গ্রামটি। এই গ্রামে রয়েছে নিজস্ব সংবিধান। গ্রামটিতে ঢুকতেই আপনার চোখে পড়বে নীল রঙা একটি গেইট। তাতে লেখা ‘আদর্শ গ্রাম’। গ্রামেই রয়েছে উচ্চ ও নিম্ন আদালত। সব ধরনের বিরোধ এর মীমাংসা হয় সেখানেই। এই গ্রামে দু’শো বছরের ইতিহাসে কখনো পুলিশ ঢোকেনি। কোন মামলা আ’দালতে যায়নি।
এ গ্রামে আলাদা একটা গণতান্ত্রিক প্রথা চালু আছে। উন্নয়ন ও বিচার ব্যবস্থাসহ গ্রামের যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করেন একজন চেয়ারম্যানসহ ২৩ সদস্যের হুলহুলিয়া সামাজিক উন্নয়ন পরিষদ। তাঁরাই সকল বিচার কার্য করে থাকে, গ্রামের মানুষজনও সেখানেই যায় বিচারের আশায়। যদিও দরকার পড়ে না কারন, গ্রামটিতে কোন হানাহানি, মারামারি, বিরোধ নেই!
অসাধারণ সভ্য একটা গ্রাম। এ গ্রামের একটা রাজধানী আছে। এখানে বাল্য বিবাহ নেই,যৌতুক নেই। এ গ্রামের ইতিহাসে কখনো মারামারি হয়নি। জমি নিয়ে বিরোধ বা কোন কিছু নিয়ে বিরোধ হলে তারা নিয়মতান্ত্রিক নিজেস্ব আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি করে। তারা বাংলাদেশ সরকারকে আলাদা কর্ম চাপে ফেলে দেয়না। প্রতিটা জমির খাজনাপাতি ঠিক সময়ে পরিশোধ করে। এ গ্রামে কখনো হত্যাকান্ড ঘটেনি। সবাই শিক্ষিত। তারা কেউ কেউ ফসল ফলায়, বিদেশে থাকে, অথবা চাকুরি করে। এ গ্রামে শিক্ষিতের হার ১০০%। রূপকথার মতো শোনালেও হুলহুলিয়া বাস্তবেই এক বিস্ময়কর গ্রাম। সিংড়ার চৌগ্রাম ইউনিয়নের হুলহুলিয়া গ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ‘নিয়ামত খাল’ নামের একটি ছোট নদী, যা আত্রাই নদীতে গিয়ে মিশেছে। বর্ষা মৌসুমে চলনবিলের কোলের এই গ্রামের চারদিকে পানিতে থই থই করে।
মোট ১১টি পাড়া নিয়ে হুলহুলিয়া গ্রাম। এর মধ্যে চকপাড়াকে ‘ক্যাপিটাল সিটি’ হিসেবে গণ্য করা হয়। কি নেই হুলহুলিয়াতে, রয়েছে হাই স্কুল, দুটি ব্র্যাক স্কুল, একটি মসজিদ, একটি গোরস্তান, দুটি মাজার, একটি ডাকঘর, একটি দাতব্য চিকিৎসালয়, একটি খেলার মাঠ, একটি বাজার, বরেন্দ্র প্রকল্পের দুটি গভীর নলকূপ ও বায়োগ্যাস প্লান্ট চারটি। ১৯৪৪ সালে ‘দ্য ডায়মন্ড ক্লাব’ নামে একটি ক্লাব ও গঠন করা হয়। মজার বিষয়, মাধ্যমিক পাস না করা পর্যন্ত এই ক্লাবের সদস্য হতে পারেন না কেউ। তবে এত কিছুর পরও স্বস্তিতে নেই এই গ্রামের মানুষ। কারণ নাগর নদী। এই নদীর কারণে বর্ষা মৌসুমে হুমকির সম্মুখীন হয় গ্রামটি। নাগর নদীর বাঁধ সংস্কার না করায় চলনবিলের পানির প্রবল ঢেউয়ের ধাক্কায় যে কোনো মুহূর্তে বিলীন হয়ে যেতে পারে আদর্শ গ্রামের বিরল দৃষ্টান্ত এই জনপদ। আশা করবো, কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি থাকবে আদর্শ গ্রামটির দিকে! সত্যি-ই, হানাহানি, মারামারি, বিরোধের মধ্যে হুলহুলিয়া যেনো অন্য এক শান্তির বাংলাদেশ।