ছুটিহোমপেজ স্লাইড ছবি
ঐতিহ্যের ছোঁয়ায় অন্যরকম এক রেস্তোরাঁ

আসিফ সুফিয়ান অর্নব: সেই ছোট বেলা থেকেই সবার মত আমারও স্বপ্ন ছিল যদি জমিদার বাড়ি গিয়ে জমিদারদের মত আরাম আয়েশে মোগলাই খাবার খেতে পারতাম, রীতি-পরম্পরা সামনে থেকে দেখতে পারতাম! তবে স্বপ্ন যে সত্যি হবে তা ভাবিনি! তবে তা সত্যি হয়েছে এক বড় মনের মানুষের নেক ইচ্ছায়।
বেচারাম দেউড়ির জমিদার বাড়িতে পা রাখার সাথে সাথে ভদ্রলোক হাস্যজ্জল মুখে বলল- ‘মেহমান আতে নেহি আপনে মর্জিসে মেহমান আতেহে আল্লাহ্ কি তরফসে রহমত অর বরকত লেকে’ বাড়িতে প্রবেশের সাথে সাথে যে ভদ্রলোক তিনটি লাইন বলেছিলেন, তিনি হলেন জমিদার বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ইমরান সাহেব। ওনার মহৎ উদ্যোগের জন্যই যে কেউ চাইলেই এখন থেকে জমিদার বাড়িতে জমিদারি কায়দায় মোগলাই খানা-দানা করার ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে। তার আগে এই নবাব বাড়ির আদি ইতিহাস সম্পর্কে জানা আবশ্যক, বাড়িটির বয়স প্রায় ২০০ বছর। পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ির বাহারি নকশা করা লাল রঙের বাড়িটি আর্মেনীয় স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত।
আঠারো শতকের দিকে ঢাকা ও সোনারগাঁয়ের জমিদার ছিলেন মৌলভী আবুল খায়রাত মোহাম্মদ, সে সময় তিনি ছয় বিঘা জমির ওপর বেচারাম দেউড়িতে এই বাড়ি নির্মাণ করেন তাই মানুষ এই বাড়িকে ছয় বিঘা বাড়ি নামেও চেনে। আবুল খায়রাতের বাবা ছিলেন মুন্সি নূর বকস, আবুল খায়রাতের দুই ছেলে আবুল হাসনাত ও আবু জাফর জিয়াউল হক ওরফে নাবালক মিয়া। তাঁদের নামেই এখন এই বাড়ির আশপাশের সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের উপকরণ ছড়ানো এই বাড়ির লোকেদের আতিথেয়তার সুনাম বহু যুগের। সেই ধারাবাহিকতায় ঐতিহ্য দর্শনের সুযোগ আর পারিবারিক আবহে রকমারি ঢাকাই খাবারের স্বাদ দিতে বাড়ির একাংশে চালু হয়েছে ব্যতিক্রমী এক রেস্তোরাঁ।
নাম ‘ইমরান’স হেরিটেজ হোম’। বাড়িটির দুটি অংশ—বাহিরমহল ও অন্দরমহল। গত শতকের পঞ্চাশ কিংবা ষাটের দশকে দুই মহলের সামনের প্রশস্ত বাগানের মধ্য দিয়ে দুই পরিবারের সদস্যরা দেয়াল তুলে বাহিরমহল ও অন্দরমহলকে আলাদা করেন। বর্তমানে বাহিরমহল নাবালক মিয়ার নাতি এ এম ইমরানের। অন্দরমহলে বসবাসরত আবুল হাসনাতের বংশধরেরা সম্প্রতি তাঁদের অংশের পুরোনো স্থাপনা ভেঙে বহুতল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করলেও এ এম ইমরান সেই পথে যোগ দেননি; বরং প্রাচীন ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে এবং বিকল্প কিছু করার অভিপ্রায় থেকে চালু করেছেন চমকপ্রদ এই রেস্তোরাঁ যদিও তিনি একে সমসাময়িক রেস্তোরাঁ বলতে নারাজ। ইমরানের মালিকানাধীন বাহিরমহলে গিয়ে চোখে পড়ে কাচের কারুকাজ করা নকশাদার স্তম্ভ, উঁচু সিলিংয়ের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বড় বড় দরজা-জানালা, নকশাদার রেলিং। বিশাল হলরুমে সাজিয়ে রাখা শতবর্ষী আসবাব। সেখানে শোভা বাড়াচ্ছে তুরস্ক থেকে আনা পুরোনো ঝাড়বাতি। সোনার প্রলেপ দেওয়া দুই শ বছরের পুরোনো পবিত্র কোরআন শরিফ, মরচে পড়া তলোয়ার, হাতে লেখা ফারসি পুস্তক, পৃথিবীর নানা দেশ থেকে সংগ্রহ করা আতরদানি, দুষ্প্রাপ্য সব ছবি ও শিল্পকর্মসহ নানা উপকরণ বাড়িটির ঐহিত্যের জানা দিচ্ছে কিছু সময়ের জন্য হলেও আপনি দেড়’শত বছর পেছনে চলে যাবেন।
পাশেই খাবার ঘর। ভবনের পরের অংশটুকু নতুন করে বানানো। ইমরান সাহেবের সাথে কথায় কথায় জানা গেল, একসময় এই বাড়িতেই আতিথেয়তা নিয়েছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, নেতাজি সুভাস চন্দ্র বসু, শিল্পী এস এম সুলতান, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, মাওলানা ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী সাহেব সহ অবিভক্ত ভারত ও পাকিস্তানের প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতারা। পঞ্চাশের দশকে যুক্তফ্রন্টের বেশ কয়েকটি বৈঠকও হয় এই বাড়িতে। কালের নানা ঘটনার সাক্ষী সাহেব বাড়ির এই অংশকে রেস্তোরাঁয় রূপ দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে এ এম ইমরান বলেন, ‘মূলত সৌন্দর্য, আতিথেয়তা ও বিভিন্ন সময়ের গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের আনাগোনার কারণে আমাদের এই বাড়ি বিখ্যাত হয়েছিল, এছাড়া আমাদের বাড়ির আরেকটি ঐতিহ্য হল আমরা বাড়িতে প্রত্যেক বেলায় খাবারের ম্যেনুতে ভিন্নতা রাখি। রেস্তোরাঁ/গেস্ট হাউজ চালুর আগে এখানে অনেক দেশের কূটনীতিকেরা এসেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা এই বাড়ি এখনো দেখতে আসেন। তাই অনেক ব্যক্তি ও স্থাপত্য নিয়ে কাজ করে এমন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয় এমন ধরনের কিছু একটা করার, যাতে কিছু আয়ের পাশাপাশি ভবনের ইতিহাসটাকেও ধরে রাখা যায়।’
তবে এটাকে প্রথাগত কোনো রেস্তোরাঁ/সাধারণ ভোজনালয় বলতে অনিচ্ছুক ইমরান। তাঁর মতে,সবাই আসবে না শুধুমাত্র ইতিহাস–ঐতিহ্যের প্রতি যাঁদের আলাদা টান আছে তাঁরাই মূলত এখানকার ভোক্তা। দর্শনার্থীরা এখানে আসেন, সবকিছু ঘুরে দেখেন আর পরিবারের সদস্যদের রান্না করা খাবার পারিবারিক পরিবেশে উপভোগ করেন। এখানে বাণিজ্যিক ব্যাপারটা মুখ্য নয়। মৌমাছি যেমন ফুলেদের মধু নেয় মিলন ঘটায়। মধুটা ঘটকালির মজুরী, তা’ছাড়া মৌমাছিরও তো অন্নদান আছে। ফুলেরা চাঁদা করে তাকে না খেতে দিলে সে বাঁচে কী করে? ব্যাপারটি সেরকম। তাই খাবার খাওয়া একটা উপলক্ষ্য মাত্র, এখানে এসে পরিবেশ এবং তাদের ব্যবহার রীতি-নীতি সবাইকে বেশী আনন্দ দেবে।
এদিন দুপুরে অতিথিদের জন্য পরিবেশন করা খাবারের তালিকায় ছিল জাফরানি পোলাও,আনারস ইলিশ, মুরগির মাংসের চপ, মুরগির রোস্ট, বিফ কাটা মসলা,চিংড়ি মাছের মালাই কারি, সালাদ এবং ঘরে বিশেষ প্রক্রিয়ায় বানানো বোরহানি এবং শেষে জাফরানি জর্দা ও স্পেসাল চা। ইমরান সাহেব জানান, রাতের অতিথিদের জন্য আলাদা বন্দোবস্ত থাকবে। এই বাড়িতে এক দিনে একই মেন্যু দুবার পরিবেশনের রেওয়াজ নেই। তিনি উপসংহার টানতে গিয়ে বলেন, অতিথী নিজের ইচ্ছায় আসে না,আল্লাহর ইচ্ছায় আসে তাই আমরা আমাদের অতিথীদের যত্ন নিতে দ্বিধা করি না।
এই রেস্তোরাঁয় খেতে হলে যোগাযোগ করতে হবে ন্যূনতম তিন দিন আগে। সর্বনিম্ন পাঁচজন ও সর্বোচ্চ ২০ জনের একটা দলের জন্য দুপুর অথবা রাতের খাবারের ফরমাশ করা যাবে। খাবারের দাম জন প্রতি ৬৯৯ টাকা থেকে শুরু করে ১০০০ টাকা। খাবারের স্বাদ একেক জনের একেক রকম তাই মতামত ভিন্ন হতেই পারে।
খাবারের তালিকা– ১। জাফরানি পোলাও – ১০/১০ ২। মুরগির মাংসের চপ- ১০/১০ ৩। আনারস ইলিশ- ৮.৫/১০ ৪। মুরগির রোস্ট- ৯/১০ (সম্মানসূচক) ৫। বিফ কাটা মসলা- ৯/১০ ৬। চিংড়ি মাছের মালাই কারি – ৭.৫/১০ ৭। বোরহানি- ১০/১০ ৮। জাফরানি জর্দা – ৯/১০
দাম- জন/প্রতি – ৮০০টাকা। খাবারের মান- ১০/১০ পরিবেশ- ১০/১০ মূল্য- ৮/১০ স্বাদ- ৯/১০ তাদের ব্যবহার- ১০০/১০ Noor Box Ln,Becharam Dewri,Old Dhaka,Bangladesh.
বুকিং করার জন্য: 01711-646462