
মাহমুদুর রহমান: গল্পের শুরু মোহনগঞ্জ থেকে, যেখানে বহুদিন বাদে ফিরে যায় রায়হান। সাথে তার বড় ছেলে রঞ্জু, মেডিকেল কলেজের ছাত্র। মোহনগঞ্জ কোথায়? সময়টাই বা কখন?
আশির দশকের গল্প। দেশ স্বাধীন হয়েছে এগারো বছর, চলছে দ্বিতীয় সামরিক শাসন। কিন্তু সে আলাপের সাথে এ গল্পের যোগ নেই। গল্প শুরু হয়েছে আরও অনেক আগে থেকে। যেদিন রায়হানের বাবা মুর্শেদ আলী প্রধানের জন্ম হয়, কিংবা তারও অনেক আগে।
মুর্শেদ আলী প্রধান এক অদ্ভুত খ্যাপাটে মানুষ। গত শতাব্দীর প্রথম চতুর্ভাগে, এক সম্পন্ন গৃহস্থের পুত্র সে। একমাত্র পুত্র। তাই তার মুখের কথা মাটিতে পড়ার আগেই তামিল হয়ে যেতো। দিনে দিনে ছেলেটি তাই হয়ে উঠেছিলো দারুন জেদী। পড়াশোনা শেষ না করে নেমেছে রাজনীতিতে। খদ্দর থেকে পার্টিশন, মুর্শেদের কেবল ব্যর্থতা। তারও অনেক পর ইয়াহিয়ার সৈনিকের গুলি তার বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে দেয়।
কিন্তু মুর্শেদের গল্প এখানে শেষ হয় না, বরং শুরু হয়। কেননা, তার ছেলে এবং নাতি যখন ভারতের মোহনগঞ্জ গিয়ে মুর্শেদের পরিত্যাক্ত সম্পত্তির সদগতি করতে চায়, তখন একে একে উঠে আসে মুর্শেদের জীবনের কথা। তার পিতার কথা। মনোতোষ ডাক্তারের কথা। সেই সঙ্গে আরও অনেক ইতিহাস, উপকথা।
এ গল্প কেবল মুর্শেদের না। গল্পটা রায়হানেরও। আমরা জানতে পারি আশির দশকে বি গ্রেড পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিকের সংসারের কথা। তার তিন সন্তানের কথা। এরশাদ শাসনামলে পোষা গুন্ডাদের হাতে ছোট বড় সব মানুষের অপমানিত হওয়ার কথা। কিংবা রায়হানের স্ত্রী বীথির একটা বাড়ি করার ইচ্ছা।
বীথি আর রায়হান যখন এক টুকরো জমির জন্য রক্ত জল করতে রাজি, সমান্তরালে আমরা জানতে পারি নিজের খামখেয়ালিতে প্রায় একটা জমিদারী বেচে দিয়েছে মুর্শেদ, একটু একটু করে। তার রাজনীতি, তার খেয়ালি জীবন আর স্ত্রী হিসেবে একটি অসামান্য রমণী সালমা খাতুনের কথা, যাকে মুর্শেদ কখনও বোঝেননি।
গল্পগুলো কখনও বেরিয়ে আসে রায়হানের বন্ধু চিন্ময়ের বাড়ির পুরনো জিনিসপত্রের স্তুপে পাওয়া চিঠি থেকে, কখনও রায়হান বলে রঞ্জুকে। কখনও লেখক নিজেই বলেন। সেই সঙ্গে বলেন স্বদেশী আন্দোলনের কথা, মুর্শেদের হাতে এক কিশোরীর চরকা তুলে দেওয়ার কথা। হিন্দুদের ছোঁয়াছুঁয়ি থেকে গল্প বয়ে যায় তেভাগা আন্দোলন পর্যন্ত।
নিছক কোন গল্প নয়। কেবল দেশভাগ নয়। ফকির বিদ্রোহ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের সামরিক শাসন পর্যন্ত ঘটনাবলীকে লেখক ধরেছেন মাত্র দুইশ’ পাতায়। অদ্ভুত ব্যপার হলো, তাতে কোন ঘটনার প্রতি অবিচার করেননি তিনি। দেশভাগ তো কেবল দেশভাগ নয়। সেই সঙ্গে ছিল সমান্তরালে আরও অনেক ঘটনা। নন ফিকশনেও সেসব তোলা হয় না, যা তুলেছেন শওকত আলী। তৎকালীন ঘটনার সাথে মানুষের বদলে যাওয়া, তাদের যোগসূ্ত্র তুলে ধরেছেন। কখনও তুলনা করেছেন পরবর্তী সময়ের সাথে। কেবল ইতিহাস নয়, ভূমি এবং মানুষের সাথে জুড়ে থাকা উপকথাও বাদ পড়েনি।
কারও কারও কাছে উপন্যাসটা খাপছাড়া লাগতে পারে। মনে হবে, লেখক নিজের পুরো ক্ষমতাকে ব্যবহার করেননি। কিন্তু মূলত শওকত আলীর অন্যান্য অনেক উপন্যাসের চেয়ে ‘ওয়ারিশ’ অনেক ভারী উপন্যাস। ওয়ারিশে তিনি দশ লাইনকে প্রকাশ করেছেন এক লাইনে। এ বইয়ের বিশ্লেষণে আরও চার পাঁচটি বই দাঁড়িয়ে যাবে। এ পর্যন্ত পড়া শওকত আলীর বইয়ের মাঝে এটা অন্যতম সেরা।
নামকরণ প্রসঙ্গে কিছু কথা না বলে পারছি না। রঞ্জু-রায়হান-মুর্শেদের এই পুরুষানুক্রমের জন্য এ বইয়ের এমন নামকরণ বলে আমার মনে হয় না। বরং, এ বইয়ের পাঠকরাও এই ভূখন্ডের ইতিহাস, উপকথার ওয়ারিশ।
*রায়হানকে প্রধান চরিত্র ধরে একই চরিত্রদের নিয়ে লেখকের আরেকটি উপন্যাস ‘দলিল’, যা এরশাদের শাসনামল নিয়ে লেখা। তবে, ‘দলিল’ ঠিক ‘ওয়ারিশ’-এর সিক্যুয়েল না।