জাতীয়হোমপেজ স্লাইড ছবি
কিছু সূর্য সন্তান এবং একজন নরপিশাচের গল্প!

আরিফুল আলম জুয়েল: সূর্য সন্তানদের গল্প বলতে এসেছি, সাথে আছে এক নরপিশাচের গল্প !!! একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা- ”আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিপিটি ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। গামছা দুটো আজও অখানে পড়ে আছে। পরনে কালো ঢাকাই শাড়ী ছিল। এক পায়ে মোজা ছিল। মুখ ও নাকের কোন আকৃতি নেই।কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে।যেন চেনা যায় না। মেয়েটি ফর্সা এবং স্বাস্থ্যবতী। স্তনের একটা অংশ কাটা। লাশটা চিৎহয়ে পড়ে আছে। বিভৎস চেহারার দৃশ্য বেশীক্ষণ দেখা যায়না। তাকে আমি চিনতে পারিনি। পরে অবশ্য সনাক্ত হয়েছে যে ,মেয়েটি সেলিনা পারভীন। ’শিলালিপি’র এডিটর।তার আত্মীয়রা বিকেলে খবর পেয়ে লাশটি তুলে নিয়ে গেছে।”
শিলালিপি পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন সেলিনা পারভীন। অল্প অল্প করে মূলধন জমিয়ে, এর ওর থেকে ধার দেনা করে পত্রিকাটি খুলেন তিনি। প্রকাশের অল্প কদিনের মাঝেই সমাদর পায় শিলালিপি। তৎকালীন বুদ্ধিজীবিদের সেরা সেরা লেখায় ভর্তি থাকতো শিলালিপির শুরু থেকে শেষ পাতা। মুক্তিযুদ্ধও বাদ যায়নি। বাদ যায়নি পাকিস্তানি সরকারের বিরুদ্ধের লেখাগুলোও। এ লেখার জন্যই সেলিনাকে টার্গেট করে হানাদাররা। পাশাপাশি শিলালিপির লাভের টাকা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের কাপড়, খাবার, অস্ত্র জোগাতেন- সে খবরও কানে গিয়েছিলো রাজাকারদের। স্বাধীনতার দুই দিন পর, ১৮ ডিসেম্বর, রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে সেলিনা পারভীনের লাশ পাওয়া যায়। বন্দুকের ধারালো বেয়নেট দিয়ে খোঁচানোর কারণে লাশ চেনার উপায় ছিলোনা। শেষে পায়ের সাদা মোজা থেকে শনাক্ত করা হয় লাশের পরিচয়।
আরেকটি বর্ণনা— “পাশে দুটো লাশ, তার একটির হৃৎপিন্ড কে যেন ছিঁড়ে নিয়েছে। সেই হৃৎপিন্ড ছেঁড়া মানুষটিই হল ডঃ রাব্বী। —————-ডঃ রাব্বীর লাশটা তখনও তাজা। জল্লাদ বাহিনী বুকের ভেতর থেকে কলিজাটা তুলে নিয়েছে। তারা জানতো যে তিনি চিকিৎসক ছিলেন। তাই তার হৃৎপিন্ডটা ছিঁড়ে ফেলেছে।” এমনি আরো অজস্র লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনায়। সেইসব মর্মান্তিক ঘটনার শুনে বারবার শিউরে উঠতে হয় !!! বধ্যভূমি! কান্নার ভূমি, রক্তের ভূমি, মেধা আর মননের ভূমি- শিউরে উঠা এক নিধন যজ্ঞ! ঘাতক-দালাল চক্র এই পৈশাচিক-নির্মম নিধন যজ্ঞের পর ঢাকার মিরপুর, রায়েরবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধিজীবীদের লাশ ফেলে রেখে যায়।
১৬ই ডিসেম্বর পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণের পরে আত্মীয়-স্বজনেরা মিরপুর ও রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে তাঁদের লাশ খুঁজে পায়। ঘাতকবাহিনী আমাদের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের পৈশাচিকভাবে নির্যাতন করেছিল। এ ঘৃণ্য কর্মকান্ডের মাস্টারমাইন্ড কে জানেন! শুধু ১৪ ডিসেম্বর নয়, ২৫শে মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের পুরো পরিকল্পনাটাও তার মাথা থেকে বের হওয়া! নাম তার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী, যে কিনা ১৩ই ডিসেম্বরের বিমান হামলার পরে প্রাণ বাঁচানোর জন্য হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলেছিল- ‘যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই!’ অথচ তার মনে ছিল দেশটাকে মননে-মেধায় নিশ্চিহ্ন করে দেয়া! বাঙালির স্বাধীনতার বিরোধীতা করা জামায়াতে ইসলামীকে কাজে লাগিয়ে দেশজুড়ে রাজাকার আলবদর আর আল শামস বাহিনী গঠিত হয়েছিল তার নির্দেশেই। ধূর্ত মস্তিস্কের রাও ফরমান আলী বুঝতে পেরেছিল, স্থানীয় লোকজন কাউকে হাত করতে না পারলে ঘরের খবর বের করা যাবে না। আর সেকারণেই আল-বদর আর আল শামসের জন্মটা তার হাত ধরেই হয়েছিল।
১৯৭৪ সালে জুলফিকার আলি ভুট্টো বাংলাদেশে এসেছিলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৮ জানুয়ারি ভুট্টোকে আনুষ্ঠানিকভাবে একটি অভিযোগ করেন। তিনি বলেন রাও মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী একটি সরকারী নথিতে লিখেছিলেন- “সবুজ পূর্ব পাকিস্তানকে লাল করে দেয়া হবে।” রাও ফরমান আলীর এই লেখাটিই পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ নির্যাতনের প্রমাণ। জেনারেল নিয়াজি তার The Betrayal of East Pakistan বইতে রাও ফরমান আলীকে একজন সুবিধাবাদি, ষড়যন্ত্রকারী এবং প্রতারক বলেছে। নিয়াজি তাকে বাঙালি গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবি হত্যাকণ্ডের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে জড়িত বলেও বর্ণনা করেছে। এই অপকর্মের জন্যই ১৫-১৬ ডিসেম্বর ফরমান আলী হয়ে উঠেছিলো প্রাণভয়ে ভীত। তাকে পাকিস্তানে ফেরত পাঠাবার জন্য নিয়াজিকে অনুরোধ করেছিলো। ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনাকারী ঠান্ডা মাথার খুনী রাও ফরমান আলী- বর্ণনা করেছে পাকিস্তানের আরেকজন আমলা আলতাফ গওহর। তিনি লিখেছেন- তার এক বন্ধু তাকে বলেন যে বাঙালি বুদ্ধিজীবিদের হত্যার নীলনকশা প্রণয়ন করা হয়েছে। তিনি বাঁচতে চান। এই বন্ধুটির নাম সানাউল হক। আলতাফ গওহর, সানাউল হকের প্রাণ রক্ষার জন্য রাও ফরমান আরীর কাছে অনুরোধ করেন। রাও ফরমান আলী তার অনুরোধ শুনে ড্রয়ার থেকে একটি ডায়েরী বের করে সানাউল হকের নামটি কেটে দেয়। সানাউল হক বেঁচে যান। স্বাধীনতার পর এই ডায়েরীটাই পাওয়া যায়। এর পাতায় লেখা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নামের তালিকা। এদের সবাইকে ১৪ ডিসেম্বর মেরে ফেলা হয়।
এই রাও ফরমান আলীর পরিকল্পনায় বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ আটক করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। শহীদ বুদ্ধিজীবিদের নাম লেখা তার ডায়েরীটা পাওয়া গিয়েছিল গণভবনে, মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় ভীত হয়ে সেটা গণভবনে রেখেই পালিয়ে গিয়েছিল রাও ফরমান আলী। পরে মিত্রবাহিনীর সদস্যরা সেই ডায়েরী উদ্ধার করেন, সেখানে লেখা নামগুলোর মধ্যে এক-দুইজন কেবল বেঁচে গিয়েছিলেন ভাগ্যগুণে। এতকিছুর পরেও আমরা কিন্তু মেধার পরিচয় দিচ্ছি; মেধা তো আসলে আমাদের ১৯৭১ এ হারিয়ে গেছে, তা নাহলে আমরা ২০২০ সালে এসে এমন প্রশ্ন উত্থাপন করি— পাকিস্তান আমলেই নাকি দেশ ভালো ছিল, বুদ্ধিজীবীরা নাকী পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ছিল, নইলে ডিসেম্বরের ১৪ তারিখ পর্যন্ত কেন তারা ঢাকায় থাকবেন? আমাদের মূর্খতার পরিচয় আমরা এর চেয়ে ভালভাবে আর কিভাবে দিতে পারি বলে?