খেলাহোমপেজ স্লাইড ছবি
জিদান, এক জাদুকরের নাম

মাহমুদুর রহমান: ২০০৬ সালের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল। ফ্রান্স আর ইতালির মধ্যকার ম্যাচ। বহুদিন বাদে ফ্রান্স আবার স্বপ্ন দেখছে একটি শিরোপার। তুলনামূলক দুর্বল দল এবার ফ্রান্সের। ভরসা একমাত্র টাক মাথার ওই অধিনায়কের উপর। তারও অবসরের সময় চলে এসেছে। নিজের সেরাটাই খেলবে সে!
কিন্তু কি যেন হলো তার। হঠাৎ ইতালির মার্কো মাতারাজ্জিকে টাক মাথার ‘ঢুস’ দিয়ে ফেলে দিলো ফ্রান্সের ভরসার জায়গা, তাদের অধিনায়ক। যার নাম, জিদান।
জিনেদিন ইয়াজিদ জিদানের জন্ম ফ্রান্সে। কিন্তু তার পৈতৃক আদি নিবাস আলজেরিয়ায়। সেখানে যুদ্ধ শুরু হলে উত্তর আলজেরিয়া থেকে পঞ্চাশের দশকে জিদানের পূর্বপুরুষ ফ্রান্সে অভিবাসী হন। জিদানের জন্ম ১৯৭২ সালে ফ্রান্সের মার্সাইল শহরে।
খুব অল্প বয়সে ইউএস সেইন্ট হেনরি ক্লাবের জুনিয়র দলে জিদানের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু হয়। এটি মার্সাইলের লা ক্যাস্তেইল্যানের একটি স্থানীয় ক্লাব। ১৪ বছর বয়সে জিদান সেপ্টেমস ত্যাগ করেন এবং লিগ চ্যাম্পিয়নশীপ এর বাছাই পর্বে অংশগ্রহণ করেন। এখানে এসেই তিনি সর্বপ্রথম এস এ কান এর রিক্রুটার জিন ভ্যারার্ড এর চোখে পড়েন। এরপর জিদান ছয় সপ্তাহ থাকার উদ্দেশ্যে কান-এ যান কিন্তু শেষ পর্যন্ত পেশাদারদের সাথে খেলার জন্য পরবর্তী চার বছর তিনি সেখানেই থেকে যান।সবাইকে তাক লাগিয়ে জিদান মাত্র ১৭ বছর বয়সে প্রথম বিভাগ ম্যাচ খেলেন। এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি।
জিদান দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী ছিলেন। ফ্রান্স এবং আলজেরিয়া উভয় দেশের নাগরিক হওয়ার সুবাদে তিনি চাইলে আলজেরিয়া জাতীয় দলের হয়েও খেলতে পারতেন। কিন্তু আলজেরিয়া ফুটবল দলের সে সময়ের কোচ আবদেল হামিদ কারমালি, যথেষ্ট গতিসম্পন্ন নয় এই অজুহাতে তাকে জাতীয় দলে নেয়া থেকে বিরত থাকেন। অতএব জিদান ফ্রান্সের হয়েই খেলতে শুরু করেন।
ফ্রান্সের জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জিদান প্রথম ম্যাচটি খেলেন ১৯৯৪ সালের ১৭ আগস্ট। চেক প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্বে অনুষ্ঠিত এই প্রীতি ম্যাচটিতে জিদান ৬৩ মিনিটের মাথায় যখন বদলি খেলোয়াড় হিসেবে মাঠে নামেন ফ্রান্স তখন ২-০ গোলে পিছিয়ে। জিদান দুইটি গোল করলে ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত ২-২ গোলে ড্র হয়।
ক্লাব ফুটবলের হিসেবে জিদান তুরিন এবং মাদ্রিদে খেলেন। জুভেন্টাস এ থাকাকালীন মার্সেলো লিপ্পির দলটির অন্যতম প্রধান খেলোয়াড় এবং প্লেমেকার ছিলেন জিনেদিন জিদান। তার দল এই সময়ে দু’বার ‘সিরি এ’ শিরোপা লাভ করে। ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালে দুইবার উয়েফা লীগ এর ফাইনাল এ ওঠে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ভাবে দুইবারই স্প্যানিশ জায়ান্ট ‘রিয়াল মাদ্রিদ’ এর কাছে তারা হেরে বসে। ২০০১ সালে জিদান জুভেন্টাস থেকে রেকর্ড পরিমাণ ৳৬৬ মিলিয়ন ট্রান্সফার ফির বিনিময়ে ৪ বছর মেয়াদে ‘রিয়াল মাদ্রিদ’ এ যোগ দেন।
১৯৯৮ সালে জিদানের প্রথম বিশ্বকাপ অভিষেক হয়। প্রথম ম্যাচে লাল কার্ড দেখতে হলেও কোয়ার্টার ফাইনাল এবং ফাইনালে জিদানের কাঁধে ভর করেই এগিয়েছিলো ফ্রান্স। কেবল তা-ই নয় ৩-০ গোলে ব্রাজিলকে পরাজিত করে শিরোপা জিতে নেয় ফ্রান্স। জিদান হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়।
২০০০ সালের ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়নশিপে জিদানের সাফল্য ছিল আকাশছোঁয়া। সেই সঙ্গে রিয়ালে তার খেলা দেখে ফুটবল বিশ্ব মুগ্ধ। কিন্তু ইনজুরি এবং নানা কারনে মাঝে কিছুদিন বিরতি দিতে বাধ্য হন জিদান। ফিরে এসে আবার মাঠ কাঁপিয়েছিলেন।
লাজুক, মিতভাষী জিদান কেন মাতারাজ্জিকে ধাক্কা দিয়েছিলেন সেকথা বিশ্ব এখন জানে। উল্লেখ্য, জিদানের সে কাজকে ‘খেলোয়াড় সুলভ না’ বললেও তাকে সে সময়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জ্যাক শিরাক, আলজেরিয়ার প্রেসিডেন্ট সমর্থন করেছিলেন। ‘উদ্বাস্তু’, ‘শরণার্থী’ সহ কুৎসিত গালাগালির সমুচিত জবাব তিনি দেওয়া জিদান ব্যক্তিগত জীবনে নানা দাতব্য কাজে জড়িত। ২০০৬ সালের নভেম্বরে তিনি ড. ইউনুসের আহ্বানে বাংলাদেশ সফর করেছিলেন একটি দাতব্য কাজের খাতিরে।
বিশ্বকাপের পরপরই অবসরের ঘোষণা দেন জিদান। এরপর অনেকদিন ফুটবল দুনিয়া থেকে বাইরে থাকলেও এক সময় কোচ হয়ে ফিরে আসেন। রিয়াল মাদ্রিদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বহুদিনের। সে সম্পর্ককে ঝালিয়ে নিতে রিয়ালের কোচ হিসেবেই যুক্ত হন। এবং ভঙ্গুর রিয়ালকে নতুন উদ্যমে সাজিয়েছেন তিনি। বর্তমানে দ্বিতীয় মেয়াদে রিয়ালের কোচ হিসেবে দায়িত্বরত আছেন ৬ ফুট ১ ইঞ্চি উচ্চতার এই ফুটবল জাদুকর।
জিদানকে নিয়ে এই লেখা শেষ করা যায় তারই একটা কথা দিয়ে। অভিবাসী জিদানকে তার সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেছিলেন, “ফ্রান্সকে আমি ভালোবাসি, আমার জন্ম এখানে। কিন্তু আলজেরিয়া এবং আমার পূর্বপুরুষের সংস্কৃতি আমার রক্তে। আমি যেমন ফরাসি হিসেবে গর্বিত, তেমনি গর্বিত আলজেরিয় হিসেবে এবং আমার এই বৈচিত্র্য নিয়ে”।