ট্রেন্ডিং খবরপ্রযুক্তিহোমপেজ স্লাইড ছবি
জেনেটিক সুপার বেবি: ভবিষ্যতের অতিমানব নাকি শুধুই কল্পনা?

বাশার আল আসাদ: জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স কি? জিনতত্ত্ব বা জেনেটিক্স বা বংশগতিবিদ্যা হল জিন, বংশবৈশিষ্ট্য এবং এক জীব থেকে আরেক জীবের জন্মগত চারিত্রিক সাযুজ্য ও পার্থক্য সম্বন্ধয় বিজ্ঞান। উইলিয়াম বেটসন ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে জেনেটিক্স শব্দটির প্রবর্তন করেন। জীবমাত্রই যে তার পিতা-মাতার বৈশিষ্ট্য আহরণ করে তা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষের জানা এবং নির্বাচিত প্রজননের মাধ্যমে তারা শস্য ও গৃহপালিত পশুর মধ্যে কাঙ্খিত গুণাবলীর সমাবেশ ঘটিয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে অস্ট্রিয়ান ধর্মযাজক গ্রেগর মেন্ডেলের গবেষণার মধ্য দিয়ে এই বিজ্ঞানের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। মেন্ডেল তাঁর পর্যবেক্ষণ থেকে ধারণা করেছিলেন পিতা-মাতা থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য পরবর্তী প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়। বংশগতির কিছু বিচ্ছিন্ন একক দ্বারা, যাদের পরবর্তীতে জিন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জিন ডিএনএ’র নির্দিষ্ট স্থানে অবস্থান করে। ডিএনএ হল এমন একটি অণু যা কিনা চারটি ভিন্ন প্রকৃতির নিউক্লিওটাইডে তৈরি, যাদের বিন্যাসই কোনো অর্গানিজমের জিনেটিক বৈশিষ্ট্যাদি নির্ধারণ করে দেয়।
রোগমুক্ত জীবন কে না চায়? সবাই জন্মের পর জীবনে কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু কেমন হবে, যদি পৃথিবীর আলো দেখার আগেই এসব রোগ বালাই থেকে মুক্ত হয়ে পৃথিবীতে জন্ম নেয়া যায়? জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং খুঁজছে সেই উপায়। মানুষকে জন্ম থেকে অতিমানব হয়ে উঠবার পথ দেখাতে চাইছে জিন প্রকৌশল। যদি সত্যিই এমন হয় তাহলে কি সেটা মানব জাতির জন্য সুফল বয়ে আনবে, নাকি মানুষকেই ফেলে দেবে সমূহ বিপদের মুখে? আজকের জেনেটিক সুপার বেবি কি রুপ নেবে আগামীর অতিমানবে?
প্রথম
চীনের সেনজেন প্রদেশের সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির গবেষক হি জিয়ানকি এভাবে ভ্রূণ এবং জিন সংশোধনের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বপ্রথম জেনেটিক সুপার বেবি জন্ম দেয়ার দাবি করেছেন। তিনি মানব ভ্রূণ থেকে সিসিআর ফাইভ জিনকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন। এই জিন এমন একধরনের প্রোটিন গঠন করে, যা কোষের মধ্যে এইচআইভি ঢুকতে সাহায্য করে। যেহেতু তিনি এই জিনটিকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন, এর ফলে পিতামাতার জিন থেকে ভ্রুণের মধ্যে এইচআইভি ঢুকতে পারবে না এবং এই ভ্রূণ থেকে জন্ম নেয়া শিশুটিও থাকবে এইচআইভির আক্রমণ থেকে মুক্ত। চীনা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা এই পদক্ষেপের তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। জিন সংশোধনের মাধ্যমে মানবশিশু জন্ম দেয়ার নিয়ম সবসময় নিষিদ্ধ থাকাই উচিত। কারণ এরকম কিছু ঘটলে, জেনেটিক প্রকৌশলের মাধ্যমে উদ্ভাবিত শিশুরা এতটাই উন্নত হবে যে, শেষপর্যন্ত মানব জাতিই হুমকির মুখে পড়ে যাবে।
দ্বিতীয়
স্বভাবতই প্রশ্ন আসতে পারে, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যবহৃত জিন এডিটিংয়ের এই বিষয় গুলোকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব? এই ব্যাপারগুলো আন্তর্জাতিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চাইতে রাষ্ট্রীয় উপায়ে নিয়ন্ত্রণ করাই শ্রেয় হবে বলে সমালোচকেরা মনে করছেন। সমালোচকরা মনে করেন, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে মানবশিশু উৎপাদনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশ্বের বেশিরভাগ আধুনিক রাষ্ট্রের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। তবে এটা জেনে রাখা ভাল, জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে মানবশিশুর জন্ম দেয়ার ফলে যে স্বাস্থ্যগত সুবিধার কথা বলা হচ্ছে তা খুবই সন্দেহজনক এবং অস্পষ্ট। সিসিআর৫ জিন নিষ্ক্রিয় করে ফেলার ধারণাটি নতুন কিছু নয়। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের বায়োটেক কোম্পানিগুলো এই ধারণাকে পুঁজি করে ইতোমধ্যে এইচআইভির আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
তৃতীয়
আমাদের জিন আমাদের বাবা-মা দুজনের কাছ থেকে প্রাপ্ত। তাই আমাদের বেশিরভাগ জিনেরই দুটি করে প্রতিরূপ জোড়ায় জোড়ায় বিদ্যমান। ফলে কোনো একটি জিনের সংশোধনের ফলে, সেটি পরবর্তী বংশের জন্মের মাধ্যমে ছড়িয়ে যাওয়ার সময় তার প্রতিরূপ আরেকটি জিনের সাথে জোড়া বাঁধতে চাইবে। ফলাফলস্বরূপ, যখন কোনো শিশু জন্ম নেবে, বাবা এবং মা- দুদিক থেকে আসা ক্রোমোজোমের মধ্যে ক্রস-ওভার হবার সময় সম্পাদিত জিনটি ভ্রুণের অন্যান্য জিনের সাথে ব্যাপক আকারে অদল-বদল হয়ে যাবে। আর এভাবেই মানবশিশু জন্মদানের জন্য জিন সংশোধনের প্রভাব, অন্যান্য জিনগত পরিবর্তনের সুবিধাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেবে। এর চাইতেও জটিল ব্যাপার হচ্ছে, কোনো একটি জিনের রূপান্তর বা পরিবর্তনের প্রভাব অন্যান্য আরো দশ থেকে একশটি জিনের সহযোজনের উপর নির্ভর করে। জিন সংশোধনের ফলে, এই নতুন জিনটি অন্যান্য জিনের মধ্যে মিশে গিয়ে সেসব জিনের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যকে বাঁধা দিতে পারে।
চতুর্থ
ভারসাম্যপূর্ণ জিন নির্বাচন কোনো মামুলি ব্যাপার নয়। ১৯৭০ এর দিকে বিজ্ঞানী লিয়েন্টিন এবং হাবি ব্যালেন্সিং সিলেকশন বা ভারসাম্যপূর্ণ নির্বাচনের একটি ধারণা সবার আগে সামনে নিয়ে আসেন, যে ধারণাটি এর আগেই একটি তত্বের বর্ণনা করা হয়েছে। তত্বটি হচ্ছে, বিভিন্ন রোগের জন্য দায়ী বিরল জিনগুলো মানবদেহে সহজেই মিশে থাকতে পারে, কারণ বংশগত ভিন্নতা অনুসারে ক্ষতিপূরণ হিসেবে তারা বিষমসত্ত্বা সৃষ্টি করতে গুরুপত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ রোগের জন্য দায়ী এই জিনগুলো এক অর্থে ভালো কাজে ভূমিকা পালন করে থাকে। ঝুঁকিপূর্ণ বা স্বাস্থ্যঝুঁকি জন্য দায়ী জিনগুলো, উপকারী জিনগুলোর সাথে হিচহাইকিং বা অনুগত ভ্রমণের মাধ্যমে জুড়ে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা এখন ডিএনএ সার্জারির আরো সঠিক পন্থা খুঁজে যাচ্ছেন। তারা দুটো ডিএনএর যুক্ত থাকা বিটকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন।
পঞ্চম
তবে বিজ্ঞানীরা জিন প্রকৌশলের মাধ্যমে অত্যাধুনিক মানবশিশু জন্মদান নিয়ন্ত্রণ করবেন কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। ১৯৭০ এর দিকে ডিএনএ এবং জিন বিভক্তিকরণ শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণীর কিছু মাইক্রোবায়োলজি বিশেষজ্ঞ কর্তৃক সম্পাদন করার সুযোগ ছিল। ১৯৮০ সালে মার্টন ক্লাইন নামক একজন ইউসিএলএ গবেষক সর্বপ্রথম অনুমোদন ছাড়াই মানব কোষে জিন সংশোধনের চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৯৬ সালে ডলি নামক একটি ভেড়ার ক্লোন করার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, জিন সংশোধনের মাধ্যমে আসলেই হয়তো মানবশিশু জন্ম দেয়া সম্ভব।
ষষ্ঠ
জিন এডিটিংয়ের প্রযুক্তি এখন যেমন আগের চাইতে আরো বেশি পেশাদার এবং সহজ হয়ে উঠেছে, তেমনই জিন এডিটিংয়ের জন্য দরকারি জেনেটিক ইনফরমেশনও আগের চাইতে আরো সহজলভ্য। ড্যানিয়েল পস্থুমার কথাই ধরা যাক। ২০১৭ সালে এই বিজ্ঞানী ৫২টি জিনকে মানব বুদ্ধিমত্তার সাথে যুক্ত করেছিলেন। যতটা সহজে ভাবা যায়, বাস্তবতা আসলে এতটা সহজ নয়। শারীরিক রোগ বালাই থেকে হয়তো এসব শিশু মুক্ত থাকবে, কিন্তু মানসিক সমস্যাগুলো সমাধানের কোনো পথ এখনও খুঁজে পাননি বিজ্ঞানীরা। অতএব আজকের জেনেটিক সুপারবেবি যে আগামীর অতিমানবস্তৃষ্টির প্রাথমিক ধাপ, তা এখনই নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। আর আসলেই যদি এমন কিছু সম্ভব হয়, তাহলে স্বাভাবিক মানুষের সাথে এদের সামঞ্জস্যতা এবং সাম্যবাদ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে সেটিই প্রধান চিন্তার বিষয়।