বিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
দিল্লী ক্রাইম: নির্জলা বাস্তবের আখ্যান

মাহমুদুর রহমান: ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর দিল্লীর মুনিরকা অঞ্চল থেকে একটি বাসে ভ্রমণ করার সময় জ্যোতি সিং নামে এক নারী গণধর্ষণের স্বীকার হন। রাত আনুমানিক সাড়ে নয়টার সময় তিনি এবং তার বন্ধু সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার সময় এই ঘটনা ঘটে। বাসে থাকা ড্রাইভার এবং তার ছয় সহকারী প্রথমে জ্যোতি এবং তার বন্ধুকে মারধর করে ছিনতাই করার চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে জ্যোতিকে বাসের পেছনে টেনে নিয়ে তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করা হয়। এবং উভয়কে উলঙ্গ অবস্থায় বাস থেকে ছুঁড়ে ফেলে পিষে মারার চেষ্টা করা হয়।
ঘটনার পরপর এ নিয়ে ভারতে তোলপাড় শুরু হয়। কেবল ভারত নয়, কুৎসিত এবং বিকৃত এ ঘটনার প্রতিবাদ আসে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে। আশার বিষয় হলো ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দিল্লী পুলিশের তৎপরতায় একে একে সব ধর্ষককে ধরা সম্ভব হয়। সে ঘটনা নিয়েই এ বছর ‘নেটফ্লিক্স’ তৈরি করলো সাত পর্বের একটি সিরিজ, নাম ‘দিল্লী ক্রাইম’।
পাঠক, জ্যোতির সাথে সেদিন কি ঘটেছিল সে বর্ণনায় যাবো না। কেননা বিস্তারিত বিবরণ স্পর্শকাতর এবং তা ছাড়াও সচেতন পাঠক মাত্রই এ ঘটনা জানেন। তবু কারও আগ্রহ হলে একটু গুগল করলেই পেয়ে যাবেন বিস্তারিত। এখানে কেবল ‘নেটফ্লিক্স’-এর সিরিজ নিয়েই বলে হবে।
সিরিজ শুরু হয় দিল্লী পুলিশের দৈনন্দিন কিছু কর্মকাণ্ড দেখানোর মধ্য দিয়ে। তার পরেই কাহিনী প্রবেশ করে মূল অংশে। দেখা যায় সড়কের ধারে দুটি নগ্ন মানুষ পড়ে আছে। পেট্রোল পুলিশ তা দেখে কন্ট্রোল রুমে খবর দিলে কর্তব্যরত পুলিশ এসে ‘ভিক্টিম’-দের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করে।
সিরিজ অনুসারে দিল্লী উত্তরের ডেপুটি কমিশনার বর্তিকা চতুর্বেদী এই কেসের দায়িত্বে এগিয়ে আসেন এবং সে রাতেই তার দলবল তৈরি করে অপরাধীদের সন্ধান শুরু করেন। ভিক্টিম দীপিকার সঙ্গী আকাশের কাছ থেকে যথাসম্ভব তথ্য নিয়ে তাৎক্ষণিক কাজ শুরু করে দিল্লী পুলিশ। এবং দুই দিনের মাথায় ছয় অপরাধীকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়।
কিন্তু কাজটা কি সহজ ছিল? একটা বাস, দুজন ভিক্টিম, ছয়জন অপরাধী। ক্লু হিসেবে আছে কেবল সামান্য কিছু তথ্য। বাঁধা হিসেবে থাকে মিডিয়া, রাজনৈতিক চাপ, পাবলিক সেন্টিমেন্ট। এসবের মাঝে দাঁড়িয়ে কি করে সম্ভব হলো অপরাধীদের গ্রেপ্তার?
মূলত ভারতের সিনেমা জগত তথা বলিউড এখনও গ্ল্যামারাস, বডিবিল্ডার আর দুর্নীতিবাজ পুলিশ চরিত্র নিয়ে কিছু সিনেমা তৈরি করেছে। কিন্তু অপরাধ, অপরাধী, অপরাধ জগত নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে পুলিশকে কত কিছুর মোকাবেলা করতে হয়, তা একদম স্পষ্ট এবং সরাসরি দেখানো হয়েছে ‘দিল্লী ক্রাইম’ সিরিজে।
ডেপুটি কমিশনার বর্তিকা চতুর্বেদী অপরাধীদের খুঁজে বের করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কিন্তু তার তৈরি করা দলে আছে নানা রকমের মানুষ। সে ভিন্ন চিন্তা, ভিন্ন ভাবের পুলিশ সদস্যদের একত্র করে কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের দলনেতার উপর কতোটা চাপ যায় সে গল্প বলে এই সিরিজ। কাজ করার সময় ভিক্টিমের পরিবারের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করতে হবে, মিডিয়াকে কিভাবে সামলাতে হবে, এবং ক্রমাগত ‘উপর মহলের চাপ’ সামলিয়ে নিজ কাজে অটল থাকা কাজের প্রতি কতোটা সৎ থাকলে সম্ভব, তা জানায় ‘দিল্লী ক্রাইম’।
দিল্লী ক্রাইম যে কেবল দিল্লী পুলিশ কিংবা ভারতের পুলিশের কথা বলে, এমন নয়। মূলত উপমহাদেশে বিশেষত ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের পুলিশের একই অবস্থা। উন্নত বিশ্বে যেখানে পুলিশ সদস্যরা নানা রকম সুযোগ সুবিধা পায়, এখানে তা নেই। কখনও ডেডিকেটেড পুলিশ অফিসারকে নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে মামলার কাজ সামলাতে হয়। উপযুক্ত বাসস্থান নেই নিচের সারির পুলিশদের। থাকে অতিরিক্ত ডিউটি চাপ।
বলিউডের ‘সিংগাম’, হালের ‘সিম্বা’, কিংবা পুরনো দিনের অমিতাভ বচ্চন, শশী কাপুরের করা ‘আদর্শ পুলিশ’ তকমা থেকে বেরিয়ে এসে একদম বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছে ‘দিল্লী ক্রাইম’। কেবল দিল্লী পুলিশ নয়, সেই সঙ্গে উঠে এসেছে দিল্লীর সে চিত্র যা সাধারণত সিনেমা কিংবা টিভি সিরিয়ালে ফুটে ওঠে না। দিল্লীর নিম্ন শ্রেণীর মানুষ, তাদের মনোভাব, ঘুপচি বাসস্থানের আসল ছবি তুলে ধরে ‘দিল্লী ক্রাইম’।
নেটফ্লিক্সের এই সিরিজটি নির্জলা বাস্তবকে কোন রকম পালিশ ছাড়া তুলে ধরে। গল্পের প্রয়োজনে মূল ঘটনা থেকে কিছু সরে যেতে হয়েছে অবশ্যই। কিন্তু গল্প, নির্মাণ এবং উপস্থাপনা অসাধারণ। পুরোটা সময় ঘটনার সঙ্গেই থাকে দর্শক।
অভিনয় শিল্পীদের প্রসঙ্গে বলতে গেলে পুরোটা সময় মুগ্ধ করে রেখেছেন বর্তিকা চতুর্বেদীর চরিত্রে অভিনয় করা শেফালি শাহ্। রাজেশ তৈলঙ্গ, নীতি দুগাল ভালো অভিনয় করেছেন। দায়িত্বশীল পুলিশ কমিশনারের চরিত্রে আদিল হুসেইন চমৎকার কাজ করেছেন। অন্যান্য পুলিশ সদস্য এবং অন্য আরও চরিত্রে অভিনয় করা প্রায় প্রতিটি মুখই অপরিচিত। কিন্তু প্রত্যেকে নিজ চরিত্রটি দারুণ ফুটিয়ে তুলেছেন। সম্ভবত এখানেই নেটফ্লিক্স সবচেয়ে ভালো কাজ দেখিয়েছে।
মূলত আমাদের চেনা গ্ল্যামারাস উপস্থাপনা থেকে বাস্তবের পরিস্থিতি কতোটা আলাদা, ‘দিল্লী ক্রাইম’ আমাদের সামনে সেই গল্পটা তুলে ধরেছে। দুঃখিত; গল্প নয়, নির্জলা বাস্তবের উপস্থাপন ‘দিল্লী ক্রাইম’।