বিনোদনসিনেমা ও টেলিভিশনহোমপেজ স্লাইড ছবি
নগরকীর্তনঃ অন্য মনের বাঁচার অধিকার

মাহমুদুর রহমান: আমরা এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি যখন বিশ্বব্যপী বলা হচ্ছে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’। ‘বডি শেইমিং’, ‘বুলি করা’ প্রভৃতির বিরুদ্ধে রীতিমত সামাজিক আন্দোলন চলমান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সেই ঝড় বাস্তব জীবনে যে প্রভাব ফেলছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ফেয়ারনেস ক্রিম উৎপাদন এবং বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানের যখন তাদের পণ্যের নাম বদল করে। এর বাইরেও নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রাপ্য সম্মান চাইছে মানুষ। একা নয়, সংঘবদ্ধভাবে দাবী নিয়ে কখনও রাস্তায় নামছে, কখনও মিডিয়ায় কথা বলছে, লিখছে। তাদের কথা শুনে, লেখা পড়ে সেই ‘ক্যাম্পেইনে’ যোগ দিচ্ছে অন্যরাও।
কিন্তু গায়ের রঙ, ওজন, আকার, আকৃতি, ধর্ম, বর্ণের ক্ষেত্রে মানুষ যদিও সহনশীলতা মেনে নিচ্ছে বা ভাবছে, এমন অনেক ক্ষেত্র আছে যেখানে নিজেদের চেয়ে ভিন্ন ধরনের মানুষকে মানব সমাজ মেনে নিতে পারে না। কেউ কেউ তাদের পক্ষে কথা বলে, সামাজিক মাধ্যমে কাজও হয় কিন্তু দিনশেষে তারা ব্রাত্যই থেকে যায়। মানুষের সংস্কার এতো গভীর এবং সমাজের মূলে, মানুষের ভেতরে প্রোথিত যে তারা নিজেদের চিন্তার বাইরে পা রাখতে সাহস করে না। তাই বিষয়টা যখন ‘লিঙ্গ’ নিয়ে, তখন ভিন্ন মত, ভিন্ন চিন্তা বা চাহিদার মানুষেরা সমাজে তাদের প্রাপ্য স্থান বা সম্মান কোনটাই পায় না।
মোটা দাগে ‘লিঙ্গ’ বলতে আমরা যা বুঝি তা শারীরিক। অর্থাৎ একটি অঙ্গ। কিংবা কয়েকটা বিশেষ শারীরিক চিহ্ন যা মানুষকে (কিংবা যে কোন প্রাণীকে) নারী এবং পুরুষ হিসেবে আলাদা করে। কিন্তু বহু আগে থেকেই দেখা গেছে শারীরিক বৈশিষ্ট্যে পুরুষ হয়েও অনেকে নারীসুলভ আচরণ করে, কিংবা শরীরে নারী হয়ে পুরুষসুলভ আচরণ করে। যদিও দ্বিতীয় প্রকরণে উদাহরন কম। কিন্তু নেই এমন নয়। তাই এই আলোচনায় দুটো বিষয় আসে—‘সেক্স’ এবং ‘জেন্ডার’।
যদিও চলতি কথায় সেক্স শব্দটি যৌন সহবাস হিসেবে ব্যবহৃত কিন্তু আভিধানিক অর্থ ‘স্ত্রী পুরুষ প্রভেদ চিহ্ন’। বাংলায় আমরা লিঙ্গ বলে যে শব্দটি ব্যবহার করি, তার ইংরেজি ‘জেন্ডার’। জেন্ডার দিয়ে আসলে একটা শারীরিক-মানসিক অবস্থা বোঝানো হয়। সেক্স একটা শারীরিক চিহ্ন আর জেন্ডারের হলো পরিচয়। একজন মানুষ নিজেরে নারী মনে করবেন, না পুরুষ সে পরিচয় হলো জেন্ডার। অর্থাৎ জন্মগতভাবে কারও কেউ masculine sex এর ধারক হয়েও নিজেকে feminine gender মনে করতে পারেন, বা উল্টোটাও হতে পারে।
ঈশ্বর মানুষকে এতোটা বিচিত্রভাবে তৈরি করেছেন যে কিছু বিষয় এখনও মানুষের বুদ্ধির অতীত। আর সভ্যতার সূচনা থেকে শরীর, যৌনতা ইত্যাদি বিষয় এতোটাই স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে যে নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্কই একটা গোপনীয় বিষয় হিসেবে বিবেচিত সেখানে অন্য কোন চাহিদা বা রুচি নিয়ে আলোচনার তো অবকাশই নেই। ধর্মীয় ভাবে সেগুলো পাপ আর সামাজিক ভাবে অপরাধ। এমন কথা এখনও প্রচলিত যে সম লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ প্রাকৃতিক নয়। সেকথা যদি মেনে নেওয়াও হয়, নারী কিংবা পুরুষ নয় এমন মানুষ যে প্রাকৃতিক বা ঈশ্বরের সৃষ্টি তাতে তো সন্দেহ নেই। কিন্তু সভ্য সমাজ তাদেরও আলাদা করে দিয়েছে।
২.
গৌরচন্দ্রিকা দীর্ঘ হয়ে গেল তবে এতে বাকি লেখাটা ধরতে সহজ হবে। কেননা কৌশিকের ‘নগরকীর্তন’ এমনই মানুষদের গল্প। এ গল্প শুরু হয় কীর্তনের দলের একটা অনুষ্ঠান থেকে। সেখানে ঢোল বাদক অসুস্থ হয়ে পড়লে দলের বাঁশি বাদক তাকে বাড়ি পৌঁছে সাইট চায়। সেখানে গিয়ে বাঁশিওয়ালা মধু বুঝতে পারে ‘মাস্টারদা’ যেখানে থাকেন তার নীচতলাটা হিজরাদের থাকার জায়গা (হিজরা শব্দটা ব্যবহারে অনেকের আপত্তি হয় আজকাল। কিন্তু সিনেমা অনুসারে এখানে এই শব্দই ব্যবহার করব)।
হিজড়াদের এই ঠেকেই মধুর সাথে পরিচয় হয় পুঁটির। পুঁটির পরিচয় সে একজন হিজরা যে অন্যান্য হিজড়াদের সঙ্গে সিগন্যালে টাকা তোলে। কখনও হয়ত বায়না পেলে কোথাও গিয়ে নেচেও আসে একপাক। এক কী দেড়খানা ঘরে তাদের দশজনের বাস। সেখানে অন্যরা বয়সে পুঁটির অনেক বড়। তারা পোড় খাওয়া মানুষ। পুঁটির কাঁচা বয়স। তাই সে মজে যায় মধুতে।
মধু কাজ করে চাইনিজের ডেলিভারি ম্যান হিসেবে। অর্ডার অনুসারে খাবার নিয়ে পৌঁছে দেয়। অবসরে কীর্তনের দলে বাঁশি বাজায়। বৈষ্ণব মধুর গলায় তুলসীর মালা। তার পরিবার বংশানুক্রমে কীর্তন গায়, সে কথা আমরা জানতে পারি সিনেমার দ্বিতীয়ার্ধে। প্রথম অংশে আমরা দেখতে পাই পুঁটির ঠাই আর মধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠার প্রাথমিক যোগাযোগ।
দ্বিতীয়ার্ধে কৌশিকের গল্প আমাদের নিয়ে যায় ধীরে ধীরে পুঁটির জীবনের গভীরে। যেখানে সে পরিমল থেকে পুঁটি হয়ে ওঠে। বর্তমানের মাঝে অতীত আর অতীতের মাঝে বর্তমান এনে কৌশিক আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখেন। আমরা কৌশিকের ফ্রেমে দেখি ছেলেবেলা থেকে পুঁটির মেয়ে সাজার ইচ্ছা। নিজের গ্রামেরই একটা ছেলের প্রেমে পড়া। এসব দেখতে দেখতেই কৌশিকের সিনেমায় আমরা পুঁটি আর মধুর সাথে পালিয়ে যাই কলকাতা থেকে নবদ্বীপ। মধুর পরিবারের কাছে পুঁটির পরিচয় লুকিয়ে রাখা আর এক কীর্তনের আসরে হঠাৎ পুঁটির পুরুষ বাহ্যিকতা বেরিয়ে আসা।
৩.
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে মুক্তি পাওয়া ‘নগরকীর্তন’ সাধারণের জন্য অনলাইনে মুক্তি পেয়েছে সাড়ে তিন বছর পর। আসলে এমন গভীর সিনেমা পেক্ষাগৃহের জন্য তো নয়। তার উপর এর বিষয় স্পর্শকাতর। তাই হয়ত এই পদক্ষেপ।
এমনিতে কৌশিক বরাবরই মূল ধারার বাইরে সিনেমা করেন। তার সিনেমার বিষয় বামনদের সুখ দুঃখ, হরবোলার একাকী জীবন, কখনও সীমান্তের এপাড় ওপাড়। সেই কৌশিক যখন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ফ্রেমে ধরেন তখন সে চলচ্চিত্র অন্য মাত্রা পায়।
যদিও সাবটাইটেলে সিনেমার নাম দেখানো হয়েছে ‘The eunuch and the flute player’ কিন্তু এখানে পুঁটিকে কিছুতেই eunuch অর্থাৎ হিজরা বলা চলে না। কেননা সিনেমা জুড়ে এটাই বোঝা গেছে যে প্রথম জীবনের পরিমল শারীরিক বৈশিষ্ট্যে পুরুষ কিন্তু মন থেকে সে নারী হিসেবে নিজেকে চিনেছিল অর্থাৎ তাকে হিজরা বলা যায় না। বলা যায় পুঁটি রুপান্তরকামী।
এখানে এসেই মূলত মানুষের চিন্তা গুলিয়ে যায়। কেননা এখনও আমরা হিজরা, রুপান্তরকামী, সমকামীর পার্থক্য বুঝি না। মূলত রুপান্তরকামী সেই ব্যক্তি যিনি একটি সেক্স নিয়ে জন্মান কিন্তু মানসিক ভাবে তিনি অন্য জেন্ডার ধারণ করেন। যেমন পুঁটি পুরুষের শরীর নিয়ে জন্মে নিজেকে নারী মনে করে। অন্যদিকে সমকামী সে, যে নিজেকে পুরুষ মনে করেই পুরুষের প্রতি আসক্ত। হিজরা মূলত নপুংসক।
এ কারণেই সিনেমার এক জায়গায় মধুকে পুঁটি জিজ্ঞেস করে মধু যখন পুঁটির কাছাকাছি এসেছিল তখন মধুর তাকে পুরুষ মনে হয়েছিল কিনা।
এখানে একটা টানাপোড়েন চলে কিন্তু কৌশিক তার সিনেমার গল্পে সে টানাপোড়েন রাখেননি। ‘নগরকীর্তন’ সিনেমার গল্পে মধু সত্যিই পুঁটিকে ভালোবাসে এবং সততার সঙ্গেই তাকে হিজরেদের মধ্যে থেকে নিয়ে পালিয়ে একসঙ্গে থাকার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু পরিবার, সমাজের নিয়মের কাছে তো তারা বাধ্য। যেমন সেই বাধ্যবাদকতা ছিল পরিমলের উপর। তাই পরিবার থেকে পরিমল বেরিয়ে এসে থিতু হয়েছিল কলকাতার এক হিজরে দলে।
৪.
ভারতের হিজরা সমাজ নিয়ে বই লিখেছিলেন নিলয় বসু। সেখানে তিনি হিজরা সমাজের বসবাস, জীবনাচরণের প্রামানিক অথ্য উপস্থাপন করেছিলেন। ‘হলদে গোলাপ’ উপন্যাসে কাজটি আরও চমৎকারভাবে করেছিলেন স্বপ্নময় চক্রবর্তী। রেডিওতে কাজ করার পরবর্তী সময়ে স্বপ্নময় চক্রবর্তী নানা ভাবে হিজরা, রপান্তরকামী এবং অন্যান্য রুচির মানুষদের সম্পর্কে জেনেছিলেন। তিনি তার সেই অভিজ্ঞতালব্ধ চিত্র উপন্যাসে তুলেছিলেন।
আমাদের মতো মানুষ যারা এই জীবন নিজ চোখে দেখেনি (দেখা সম্ভবও না, কেননা যদিও আমরা অনেকে এই মানুষদের ঘৃণা করি না কিন্তু তাদের অন্দরে প্রবেশাধিকার নেই। সামাজিক ভাবে তারা যেমন ব্রাত্য, তারা নিজেদের সেভাবেই আলাদা করে রেখছেন) কিন্তু বই পড়ে তাদের জীবনাচরণ, বসবাস, রীতিনীতি যা জেনেছি কৌশিকের সিনেমায় তাই দেখতে পাই। প্রতিটি গ্রুপের একজন গুরু-মা থাকেন যেমন থাকে পতিতালয়ে। এখানেও নানা বিধিনিষেধ, নিয়মের মাঝে আবদ্ধ। সে নিয়ম ভেঙে বেরনো কঠিন। কিন্তু পুঁটি তাই করেছিল।
কৌশিকের সিনেমায় এই জীবনের আরও প্রত্যক্ষ চিত্র আনা সম্ভব ছিল (যেমন করেছেন স্বপ্নময়, এমনকি খোদ কৌশিক করেছেন ‘আরেকটি প্রেমের গল্প’ সিনেমায়)। এখানে আমার অতৃপ্তি। কিন্তু তিনি হয়ত ইচ্ছা করেই তা করেননি কেননা অতটা গ্রহণ করার সামর্থ্য দর্শকের নেই। এখানে গল্পকার কৌশিক পুঁটি আর মধুর মানসিক চাওয়ার কথা বলেছেন আর পরিচালক কৌশিক তা ফ্রেমে তুলে এনেছেন। তা করতে গিয়ে আর্টের সিল দিয়ে বাস্তব থেকে দুরেও সরে যাননি। সিনেমা হিসেবে, কৌশিকের ক্ষমতার সামনে ‘নগরকীর্তন’ ততো ভালো কাজ যদিও হয়নি, তবু না হওয়া সময়ে অনেক কিছু হয়ত হলো।
ভিন্ন রুচির, ভিন্ন চাহিদার এমন গল্প নতুন নয়। ভারতের মহাগ্রন্থ ‘মহাভারত’ পর্যন্ত চিত্রাঙ্গদা, শিখণ্ডীর কথা বলে। সে আখ্যানের গভীর পাঠে রুপান্তরকামীতার কথাই সারবত্তা হিসেবে পাওয়া যায়। মহাভারতকে যদি পুরাণ বলে সরিয়েও রাখি, পাশ্চাত্যে এই কিছুদিন আগে ‘দি ড্যানিশ গার্ল’ তৈরি হলো সত্য ঘটনা অবলম্বনে। বাংলা সাহিত্যেও সমকাম, রুপান্তরকামীতার দৃষ্টান্ত দুর্লভ নয়। সৈয়দ সিরাজের ‘মায়া মৃদঙ্গ’ উপন্যাসটা যাত্রাদলের (আলকাপ) ভেতরকার সমকাম, রুপান্তরকামীতার প্রেমের গল্প। একই প্লটে লেখা আফসার আমেদের ‘এক আশ্চর্য বশীকরণ কিসসা’। আমাদের দেশে হুমায়ূন আহমেদ তাঁর ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ উপন্যাস এবং সিনেমায় এই একই জিনিস দেখিয়েছেন। সবচেয়ে বড় উদাহরণ কিংবদন্তি পরিচালক ঋতুপর্ণ ঘোষ।
রংধনু আন্দোলন কিংবা শিক্ষিত, শিল্প মানসিকতার ব্যক্তিদের এই সময়ে ‘এলজিবিটি রাইটস’ নিয়ে কথা বলাকে অনেকে আধুনিকতা, পাপ, বিকৃত যৌনাচার ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দেন কিংবা বলেন এসব পাশ্চাত্যের সৃষ্টি। কিন্তু ঘেঁটু গান, ঘেঁটুর দল, আলকাপ, যাত্রায় ছুকরি সাজা ছোকড়াকে নিয়ে টানাটানি কদাচ পাশ্চাত্যের আমদানী নয়। এসব আমাদের মাঝেই ছিল। এই সময়ে ভিন্ন রূপে প্রত্যক্ষ হয়ে দেখা দিয়েছে।
কিন্তু সামাজিক আন্দোলন বা আলোচনা সমালোচনার বাইরেও কিছু জিনিস আছে। সেটা মানসিক। ঘেঁটু দলে না থেকেও অনেক ছেলে ছোটবেলা থেকে মেয়েদের মতো সাজতে চায় কিংবা কোন কোন মেয়ে পুরুষালী হয়েই থাকে। শারীরবৃত্তীয় দৃষ্টিতে বলা যায় ‘হরমোন ইমব্যলেন্স’ এর জন্য দায়ি। যদি সেটাই হয়, সেখানে মানুষের নিজের হাত কোথায়? তার অঙ্গ পুরুষ/নারী হলেও শরীরের ভেতরের রাসায়নিক তাকে নারী/পুরুষ বলে জানায় আর মানুষটা সেভাবেই আচরণ করে।
৫.
ঋতুপর্ণ অঙ্গ বদলের দিকে হেঁটেছিলেন। নিজের সিনেমাতেও তিনি তাই দেখিয়েছেন। এমনকি ড্যানিশ চিত্রশিল্পী লিলি এলবি (তাকে নিয়েই ‘দ্য ড্যানিশ গার্ল’ তৈরি) অস্ত্রোপচার করিয়েছিলেন। কিন্তু কৌশিক তার গল্প সেদিকে নেননি। সে মেসেজও তিনি দেননি। বরং মধুর মুখ দিয়ে কৌশিক পুঁটিকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে সে যেমন আছে তেমনই সে সত্য।
কৌশিকের পরিচালনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। চমৎকার সব ফ্রেম এই সিনেমায়। মধু চরিত্রে ঋত্বিক চক্রবর্তী অসাধারণ কাজ করেছেন আর সবকিছু ছাড়িয়ে গেছে ঋদ্ধি সেন। পুঁটির চরিত্রে, সেই সময়ের ২০ বছর বয়সী এই ছেলেটা সম্ভব জীবনের অন্যতম সেরা কাজটা করে গেছে। বলনে না হলেও চলনে তার নারী-ভাব, একটা দৌড়ের দৃশ্যে হাত বাঁকিয়ে রাখা; এখানে যেমন পরিচালকের কৃতিত্ব আছে তেমনি কৃতিত্ব ঋদ্ধির।
পৃথিবীতে এখনও দেশ, ধর্মের নামে মানুষকে হত্যা করা হয়। যৌনতা এখনও ট্যাবু। কিন্তু গণিতবিদ অ্যালান ট্যুরিং, শিল্পী লিলি এলবি কিংবা ঋতুপর্ণের বিষয়টা যৌনতা ছিল না। তাদের বিষয়টা ছিল নিজের পরিচয়, আইডেন্টিটি। অন্তত তারা তাই বলেছেন। এখনকার ভাষায় জেন্ডার আইডেন্টিটি। ট্যুরিং সেটা পাননি। পাচ্ছে না আমাদের আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা অনেক মানুষ যারা পুঁটির মতো বাধ্য হয় হিজরা না হলেও একটা বদ্ধ, অস্বাস্থ্যকর জীবন বেছে নিতে। তারপর একটু হেরফের হলে অন্য দলের হাতে মার খেতে হয়। আর সমাজে বসে নিজের চাহিদার কথা বললে হয়ত সভ্য মানুষই তাকে মারত। যেমন মরেছিলেন ট্যুরিং।
হত্যা কিংবা নির্যাতন কোন সমাধান নয়। আধুনিকতার অনেক মাদকের মতো সমকাম, রুপান্তরকামীতা অহেতুকভাবে ছড়ানো হচ্ছে একথা যেমন সত্য তেমনি এ-ও সত্য কিছু মানুষ সত্যিই মনে এসব ধারণ করে। যদি বিজ্ঞান প্রমাণ করে শারীরিক কিংবা মানসিক চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের ‘জেন্ডার’ বদল সম্ভব এবং তা সুলভ করা যায় তাহলে ভালো। কিন্তু না হলেও তাদের ভালোভাবে বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অধিকার তো মানুষের নেই। কৌশিকের ‘নগরকীর্তন’ এটুকুই বলতে চায়।