জাতীয়হোমপেজ স্লাইড ছবি
নতুন বাংলাদেশের গল্প

নয় মাসের জন্মযুদ্ধ শেষে আমারা যখন পেলাম একটি পতাকা, একটি নিজস্ব মানচিত্র। তখন আমাদের সদ্য জন্ম নেওয়া দেশ টা ছিলো যুদ্ধ বিধ্বস্ত। দেশের অর্থনীতি পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েছিল, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নেমে এসেছিল শূণ্যের কোঠায়। এমনকি খাদ্য গুদামগুলিও পুরোপুরি খালি হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভিক্ষ ছিল অবশ্যম্ভাবী। ১৯৭২ সালের খরা, ১৯৭৩ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়, আরব-ইসরাইল যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং ১৯৭৪ সালের বন্যা সার্বিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। নবগঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি বড় হুমকি ছিল স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তিসমুহের নানাবিধ ষড়যন্ত্র। তখনকার মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বলেছিলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’ অর্থাৎ তলাবিহীন ঝুড়ি। এখানে যত অর্থই ঢালা হবে, তলা না থাকায় কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
তারপর? তারপর এক নতুন বাংলাদেশের গল্প! সম্প্রতি আমরা বিজয়ের ৪৭ বছর অতিক্রম করলাম। এ দীর্ঘ সময়ে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ব্যবধান থাকলেও দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আমাদের অর্জন কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা, মানবাধিকার সুরক্ষা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে দৃশ্যমান উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ বর্তমানে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় বর্তমানে ১ হাজার ৭৫১ ডলার। বর্তমানে জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ।
২০২০ সালে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বছরে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে দাঁড়াবে বলে আশা করা হচ্ছে। রফতানি বাণিজ্যে বাংলাদেশ আশানুরূপ সাফল্য পাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানি বাণিজ্যের এ গতি বজায় থাকলে ২০২১ সাল নাগাদ তা ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করবে। তাছাড়া ক্রমাগত রেমিটেন্স প্রবাহের হার বৃদ্ধি আমাদের অর্থনীতিকে স্বনির্ভর করে তুলেছে। এক সময় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মহলের সাহায্যের জন্য নির্ভরশীল থাকতে হতো। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্পের প্রসার ও বিদেশে কর্মী প্রেরণের হার বৃদ্ধি রেমিটেন্স প্রবাহ বৃদ্ধিতে সহায়ক হওয়ায় বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পায়। এর প্রমাণ হচ্ছে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে স্বপ্নের পদ্মা সেতু নির্মাণ।
ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর প্রায় ৪০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০১৯ সাল নাগাদ এ সেতুর ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল শুরু হলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। পদ্মা সেতু প্রকল্প ছাড়াও আরও কয়েকটি ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্প রয়েছে, যেমন- যমুনা সেতুতে আলাদা রেল সংযোগ, মেট্রো রেল প্রকল্প, পায়রা সমুদ্র বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং দোহাজারী-কক্সবাজার-গুণধুম রেলপথ। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে আমরা নতুন এক বাংলাদেশ দেখতে পাবো।
বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান বাংলাদেশের সফলতা ঈর্ষণীয়। দেশের ৭৮ ভাগ মানুষ বিদ্যুৎ (নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ) সুবিধার আওতায় এসেছে। ২০২১ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার লক্ষ্যে সরকার বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন, সংস্কার ও পুনর্গঠন কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এর ফলে ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩১ সালে ৪০ হাজার মেগাওয়াট, ২০৪১ সালে অন্তত ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণ ও শিক্ষার প্রসারে অবিস্মরণীয় সাফল্য এসেছে। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংক বলেছে, সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশে হতদরিদ্রের হার ১২.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। সংস্থাটি আরও বলেছে, হতদরিদ্রের হার কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, পাকিস্তান ও ভুটানকে পেছনে ফেলেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বেড়েছে পাসের হার, কমেছে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা।
এসব অর্জনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ এমডিজির কয়েকটি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। তাছাড়া টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। টেকসই পরিবেশ উন্নয়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ হচ্ছে প্রথম দেশ, যে নিজস্ব সম্পদ থেকে ৪০ কোটি ডলার বরাদ্দ দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছে।
হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি বলা দেশ টা আজ এগিয়ে চলছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এক সুন্দর আগামীর দিকে। যে আগামী শুধুই সফলতার, স্বনির্ভরতার। তলাবিহীন ঝুড়ি আজ উন্নয়নে সারা বিশ্বের রোল মডেল। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের মতো প্রত্যক বাঙালি আজ বলতে শিখেছে, আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারবা না।