খেলাহোমপেজ স্লাইড ছবি
ফুটবলে বাংলাদেশের সোনালী অতীত

এনামুল সাদিক: পাড়ার সবচেয়ে ভদ্র ছেলেটাও ফুটবল বিশ্বকাপ আসলেই নেইমার কিংবা মেসির মত চুলের স্টাইল অনুকরণ করতে চায়। আমাদের সংস্কৃতিতে এরকম চুলের স্টাইলের নেতিবাচক ধারণা থাকা সত্বেও প্রিয় খেলোয়াড়কে ভালবাসে চক্ষু লজ্জা ভুলে বিনয়ী ছেলেটা প্রিয় বিদেশী ফুটবলারের চুলের বাহারি ডিজাইন করে সাঁইসাঁই করে ঘুরে বেড়ায়। অর্থাৎ আমাদের দেশে ফুটবল একটা ভালবাসার নাম, একটা আবেগের নাম, একটা সুপরিচিত জনপ্রিয় খেলার নাম। কিন্তু দেশের ফুটবলের অবস্থা দেখলে কেবল হতাশা ছাড়া আর কিছুই প্রকাশ করতে পারেনা দেশের আপামর জনগণ। রাত জেগে বার্সা কিংবা রিয়েল মাদ্রিদের খেলা দেখার জন্য ঘুমহীন রাত যাপিত করেন, কিন্তু দেশের মাঠে আবাহনী বা মোহামডানের খেলার খবর কজনই খবর রাখেন? একটা সময় ছিল দেশের খেলা দেখার জন্য মানুষ সকাল থেকে স্টেডিয়ামে বসে থাকতো যদিও বিকেলে খেলা শুরু হত। মারী, কবির,আশরাফ ত্রিরত্নের গল্পে দিয়েই বাংলাদেশর সোনালী ফুটবলের অতীত শুরু করি।
মারী, কবির, আশরাফ। ১৯৫৬ সালে মূলত মোহামেডান এই ত্রয়ীর জন্ম দেয়। তা আরও উপভোগ্য হয়ে উঠে ১৯৫৭ সালে জাতীয় চ্যাম্পিয়নশিপে। এই ত্রয়ী’কে নিয়ে গড়ে উঠা আক্রমণ ভাগ হয়ে উঠে ভয়ংকর। আশরাফ ছিল অসাধারণ গোলমেকার। শ্যুটিং ছিল নিখুঁত। কবির রাইট ইন, মারী লেফট ইন আর আশরাফ সেন্ট্রার ফরোয়ার্ড- এই ছিলো ওদের রসায়ন। সময়’টা ১৯১৫ থেকে ১৯৩৮।
একজন জাদুকরের খেলোয়াড়ী জীবন। এই সময়’টা নানা বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন তিনি। তিনি সামাদ, জাদুকর সামাদ। এই ধরুন, কোন এক ম্যাচ খেলার আগে পুরো মাঠ একবার ঘুরে এলো সামাদ। এসেই মাঠ কর্তাদের জানালো, মাঠ আন্তর্জাতিক মাপের চেয়ে ছোট। এই মাঠে তার দলের খেলা সম্ভব না। পরে মাঠ মেপে তার কথার সত্যতা পাওয়া গেল। শুধু একটা না এরকম আরো অনেক নজিরের জন্ম দিয়েছিলেন এই ফুটবল জাদুকর। একদিনে মাঝ মাঠ থেকে ড্রিবলিং করে বারের সামনে গিয়ে শট করলেন। কিন্তু বল ক্রস বারে লেগে ফিরে আসলো। সাথে সাথে সামাদ বললেন, এটা গোল। বার নাকি কয়েক ইঞ্চি ছোট। তার শটের মাপ ভুল হতে পারে না। পরে মেপে দেখে গেল ঘটনা সত্যি। বার আসলেই দুই ইঞ্চি ছোট ছিলো। এরকম ছোটখাটো ঘটনা থেকেই তার তুখরতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
পরবর্তী সময়ে মাঠ দাপিয়ে বেড়িয়েছেন সালাউদ্দিন তুর্য্য। মুক্তিযুদ্ধকালীন তহবিল সংগ্রহে ভারতে খেলেছেন তুর্য্য হাজরা নামে। বাংলাদেশের প্রথম পেশাদার ফুটবলারও তিনি। মারী, কবির, আশরাফ এই ত্রয়-এর মিলীত সংস্করণ বলা হত সালাউদ্দিন’কে। সালাউদ্দিন দেশের বাইরে খেলেছেন হংকং এর ক্লাব ক্যারিলিন হিল এর হয়ে। তিনি এক বছরের চুক্তিতে আবদ্ধ হন এই ক্লাবের সাথে। আনুমানিক মাসিক সাড়ে তিন হাজার টাকায় চুক্তি করেন এই ক্লাবের সাথে। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ দলের সাথে মালয়শিয়ায় খেলতে গিয়ে মারদেকা কাঁপিয়ে আসেন সালাউদ্দিন। সেখানে পরিচিতি পেয়ে উঠেন ‘নাম্বার টেন’ নামে। আবাহনী মোহামেডানের কোন এক ম্যাচের দিন বাংলাদেশের প্রথম ক্রীড়াবিদ হিসেবে বানিজ্যিক’ভাবে বের করা হয় সালাউদ্দিনের পোস্টার। ২০ টাকা মুল্যের পোস্টার নিতে মাঠের বাইরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। আসলে ৭০ এর দশক’টাই ছিলো মূলত ফুটবলের সোনালী যুগ।
তুর্য্য ছাড়াও ছিলো চুন্নু, হাফিজ, এনায়েত, আসলাম, আর সাথে মাঠ ভর্তি দর্শক। ছিলো ঝাকড়া চুলের শান্ত ছেলে নান্নু। পরবর্তীতে যে হয়ে উঠেছিলো একজন পরিণত স্টপার। আশির দশকে ছিলো মোনেম মুন্না। যাকে শুধু বাংলাদেশ না ভারতও এক নামে চিনতো। ‘হি ওয়াজ মিসটেকেইনলি বর্ন ইন বাংলাদেশ’—মোনেম মুন্না সম্পর্কে এ কথাটি বলেছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক জার্মান কোচ অটো ফিস্টার। সেই ফিস্টার যে ঘানাকে এনে দিয়েছিলেন যুব কাপের শিরোপা কিংবা টেগো’কে খেলিয়েছিলেন বিশ্বকাপের মূলপর্বে। ১৯৯১ সালে সেইসময়ের রেকর্ড অংক ২০ লাখ টাকায় আবাহনী’র সাথে চুক্তি করেন মোনেম মুন্না। হুম তার আগে বলছিলাম ক্লাবের কথা, বলছিলাম দেশের ফুটবলের প্রতি মানুষ এর আবেগের কথা। তখন আবাহনীর গ্যালারীতে মোহামেডান কিংবা মোহামেডানের গ্যালারিতে আবাহনী সমর্থক উঠলে উপর করে ফেলে দেওয়া হত। মোহামেডান, আবাহনী ম্যাচ থাকলে পুরো দেশ থমকে যেত। সালাউদ্দিন তার ক্যারিয়ারে একটি মাত্র পেনাল্টি মিস করেছিলো। এবং তাতে হার্ট এট্যাকে মারা গিয়েছিলো চট্টগ্রামের এক বাসিন্দা। আমাদের দেশেই খেলে গেছেন সামীর সাকীর, করিম মোহাম্মদ আর এমেকার মত প্লেয়ার। খেলেছেন আরো অনেকেই। আমরা জাদুকর সামাদের খেলা দেখিনি। দেখিনি তার ম্যাজিক। তবে দেখতে চাই সামাদ, তুর্য্য কিংবা মুন্নার মত নতুন কোন তরুণের পায়ের জাদুতে আবার জেগে উঠুক বাংলাদেশ ফুটবল। উদয় হোক নতুন কোন জাদুকরের।