খেলাহোমপেজ স্লাইড ছবি
বক্সিংয়ের এক অবিসংবাদিত চ্যাম্পিয়ন

আরিফুল আলম জুয়েল: ১৯৭৮ সালের ১৯শে ফেব্রুয়ারি তিনি বাংলাদেশ ভ্রমণে আসেন। বিমানবন্দরে তাঁকে বরণ করতে লাখ লাখ মানুষ ভিড় জমিয়েছিলো। ওই সফরে তাঁকে বাংলাদেশের নাগরিকত্বও প্রদান করা হয়েছিলো। এছাড়া পল্টনের বক্সিং স্টেডিয়াম উদ্বোধন করেছিলেন তিনি নিজেই। তার সম্মানার্থেই স্টেডিয়ামটার নামকরণ করা হয়েছিলো। প্রায় সপ্তাহখানেক বাংলাদেশে ছিলেন। ঢাকা, সুন্দরবন, রাঙ্গামাটি, কক্সবাজার, আর সিলেটের কয়েকটি জায়গায় ঘুরে মুগ্ধতাও প্রকাশ করেছেন।
কক্সবাজারে আখতার নেওয়াজ রুবেল নামে তৎকালীন একজন আওয়ামী লীগ নেতা তাঁকে এক বিঘা জমিও উপহার দেন। বাংলাদেশের মানুষের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে বলেছিলেন, ‘আমেরিকা থেকে বের করে দিলেও আমার আরেকটা বাড়ি থাকবে।’ আমেরিকা পৌছে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘যদি স্বর্গে যেতে চান তাহলে বাংলাদেশে যান।’ লোকটি আর কেউ নয়, তিনি মোহাম্মদ আলী! আলী শুধু বক্সিংয়েই সেরা হয়ে থাকেননি, বরং তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল পুরো বিশ্বেই।
১৯৯৯ সালে বিবিসি থেকে তাকে গত শতাব্দীর সেরা ক্রীড়াবিদ পুরস্কারে পুরস্কৃত করেন। ফুটবলার জর্জ বেস্ট, পেলে, ক্রিকেটার ডন ব্র্যাডম্যান, গলফার জ্যাক নিকোলাস, এবং অ্যাথলেট জ্যাক ওয়েনস মিলে যে কয়টা ভোট পেয়েছিলেন, আলী একাই পেয়েছিলেন তার চাইতে বেশি। তবে কেবল ক্রীড়াবিদ হিসেবেই নন, একজন মানুষ হিসেবেও অনবদ্য ছিলেন মোহাম্মদ আলী।
১৯৬৬ সালে তিনি সৈনিক পরীক্ষায় উত্তীর্ন হন, কিন্তু সেই বছরেই যুক্তরাষ্ট্রের হয়ে ভিয়েতনামের বিপক্ষে যুদ্ধে অংশ নিতে তিনি অস্বীকৃতি জানান। কারণ হিসেবে জানান, ‘আমার বিবেক আমাকে ভিয়েতনামের বিপক্ষে লড়াই করতে সায় দেয় না। আর আমি কাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করবো? তারা কখনো আমাকে কালো বলে গালি দেয় নি, তারা আমার বাবা-মা’কে হত্যা করেনি। শুধুমাত্র কালো বলে এই দরিদ্র মানুষদের উপর আমি অস্ত্র তুলে ধরতে পারি না’। তবে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বিষয়টাকে ভালোভাবে মেনে নেয়নি। সেই দেশের আদালত আলীকে ১০ হাজার ডলার জরিমানা করে, পাঁচ বছরের জেল দেয়, এবং বক্সিং থেকে তিন বছরের নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তার শিরোপা কেড়ে নেয়।
অবশ্য আলী আপিল করেন, যার প্রেক্ষিতে জরিমানা এবং জেলের শাস্তি মওকুফ হয়। মাঝের তিনটা বছর নষ্ট হয়, যে সময়টাতে সাধারণত একজন বক্সার তার ক্যারিয়ারের সেরা অবস্থায় থাকেন। ১৯৬০ সাল ছিল আলীর জীবনের স্মরণীয় একটি বছর। রোম অলিম্পিকে বক্সিংয়ে সোনা জেতেন। অলিম্পিকে স্বর্ণ পদক জয়ী খেলোয়াড় হওয়ার পরও রোমের একটি রেস্টুরেন্টে তাঁকে খাবার দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ‘অপরাধ’ তিনি ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ! রাগে, দুঃখে, অপমানে আলী অলিম্পিক মেডেলটি টাইগ্রিস নদীতে ফেলে দেন। ১৯৬১ সালে আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নেতা মালেক এল শাহাবাজের (ম্যালকম এক্স) অনুপ্রেরণায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার পর থেকে পরিচিত হন ‘মোহাম্মদ আলী’ নামে। নতুন পরিচয় সবাই সহজভাবে নিতে পারল না। বড় বড় স্পনসর মুখ ফিরিয়ে নিল। একবার প্লেনে উঠার পর বিমান বালা তাকে সিট বেল্ট বাধতে বলায় তিনি বলেছিলেন যে, ‘সুপারম্যানদের সিট বেল্টের প্রয়োজন হয় না।’ নিজের সম্পর্ক অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন তিনি, নিজেই নিজেকে গ্রেটেস্ট বলতেন।
এই ব্যাপারে তাকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার মতো এতটা নিখুঁত হলে বিনয়ী হওয়া কঠিন।’ একবার একজন সাংবাদিক আলীকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি প্র্যাকটিসের সময় কতবার বুক ডন দেন?’ আলীর উত্তর ছিল, ‘আমি যখন বুকডন দেওয়া শুরু করি, তখন গুণতে শুরু করি না। বুকডন দিতে দিতে একটা সময় হাতে ব্যথা শুরু হয়ে যায়। ঠিক তখন থেকেই গুণতে শুরু করি।’ তার জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়। সৈনিক হিসেবে কাজ করেছেন, সেটা তো আগেই বলা হলো। যে সময়টাতে তিনি বক্সিংয়ে নিষিদ্ধ হয়েছিলেন, সেই সময়ে তিনি অভিনয়ের কাজও করেছেন কিছুদিন। নিউইয়র্কের ব্রডওয়ে থিয়েটারে ‘বাক হোয়াইট’ নামে একটা নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিতও হয়েছিলেন। জাদুবিদ্যার প্রতিও আলীর আগ্রহ ছিল। সেই আগ্রহ থেকে শিক্ষক রেখে জাদু শিখেছেন। রুমাল অদৃশ্য করা, কিংবা মাটি থেকে শূন্যে ভেসে থাকার মতো জাদুও দেখিয়েছেন। বিশ্বের বিভিন্ন মানবতামূলক কাজেও আলীকে খুঁজে পাওয়া যায়। ১৯৯০ সালে ইরাক যখন কুয়েত দখল করেছিলো, তখন ১৫জন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিককেও বন্দী করা হয়। সেই মুহূর্তে মোহাম্মদ আলী স্বয়ং ইরাকে যান তাদেরকে মুক্ত করতে। ইরাকি শাসক সাদ্দাম হোসেনের সাথে আলোচনা করে সেসব বন্দীদেরকে মুক্ত করে নিয়েও এসেছিলেন।
এবার বলবো সেই কঠিন ম্যাচের কথা! আলীর জন্য সেই ম্যাচটি ছিল সবচেয়ে কঠিন ম্যাচ। ১০ রাউন্ড পর্যন্ত দারুণ প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। শেষ পর্যন্ত আলী জেতেন। ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়নশিপের অন্যতম দাবিদার ছিলেন। সে সময় হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন ছিলেন সনি লিস্টন। শুধু দুর্দান্ত বক্সারই নন, অপরাধী হিসেবে পুলিশের খাতায় নামও ছিল তাঁর। আলীর সঙ্গে লড়াইয়ের দিন ঠিক হয় ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৪। আলী ছিলেন আন্ডারডগ, কিন্তু তার পরও ম্যাচ শুরুর আগে আলী লিস্টনকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ও বিশাল কদর্য একটা ভালুক। ওর শরীর থেকে অনেক সময় ভালুকের গন্ধ বের হয়। হারানোর পর তাকে আমি চিড়িয়াখানায় দান করব।’ মানসিকভাবে লিস্টনকে বিপর্যস্ত করার জন্যই আলী এ কথার লড়াই শুরু করেছিলেন। ম্যাচের আগে আলী চিত্কার করে সবাইকে বলতে থাকেন, আজ বক্সিং রিংয়ে কেউ একজন মারা যাবে! শেষ পর্যন্ত সপ্তম রাউন্ডে গিয়ে আলী লিস্টনকে ‘নক আউট’ করেন। এটি ছিল সেই সময় বক্সিং রিংয়ে সবচেয়ে বড় আপসেট। অবশ্য পরে আলীর সেরা প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠেন জো ফ্রেজিয়ার। আলী-ফ্রেজিয়ারের লড়াই সারা বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ টিভিতে দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল।
আলীর জীবনের একটা দুঃখজনক অধ্যায় হচ্ছে পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত হওয়া। ৩২ বছর এই রোগের সাথে যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত মারা গেলেন ২০১৬ সালের ৩রা জুন।