জাতীয়হোমপেজ স্লাইড ছবি
বাংলাদেশের অকৃত্রিম এক বন্ধুর বিদায়

আলমগীর শাহরিয়ার: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৭তম সমাবর্তন বক্তা ছিলেন প্রণব মুখার্জি। সে সমাবর্তনে তাঁকে ‘ডক্টর অব লজ’ ডিগ্রি প্রদান করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মোঃ জিল্লুর রহমান। দুইজনই দুই দেশে নিজ নিজ দলের ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ থেকে ‘মিস্টার ইনডিসপেনসেবল’ হয়ে উঠেছিলেন। দুঃসময়ে, দুর্দিনে দলকে টেনে নিয়ে গেছেন। রাজনৈতিকভাবে দলে খুবই বিশ্বস্ত ছিলেন। তার পুরস্কারও পেয়েছেন। এই দুজনই আজ শুধুই ছবি, কেবলই স্মৃতি। তবে বিপুল কর্মময় জীবন তাদের বাঁচিয়ে রাখবে। সেবার প্রণব মুখার্জি স্ত্রী শুভ্রা মুখার্জিকে সঙ্গে নিয়ে চিত্রা নদীর পাড়ে নড়াইলে শ্বশুরবাড়ি ভদ্রবিলা গ্রামও ঘুরে গেছেন। শৈশবের চিত্রা নদী আর স্বজনদের সঙ্গে পুনর্মিলনে উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন শুভ্রা মুখার্জি। মনে পড়ে যায় আমাদের গুণী চলচ্চিত্রকার তানভীর মোকাম্মল এর ‘চিত্রা নদীর পারে’ চলচ্চিত্রটি আর দেশভাগের উপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘সীমান্তরেখা’-র কথা।
ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান ও রীতি নীতিতে তফাৎ থাকলেও বাঙালির উৎসবের মেজাজ ও সাংস্কৃতিক বোধ এক ও অভিন্ন। আমরা যেমন ঈদের সময় ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি ফিরি, প্রণব মুখার্জিও পূজোর সময় দিল্লী থেকে বাড়ি ফিরতেন। গ্রাম ছাড়া ঈদের আমেজ পাওয়া যায় নাকি! গ্রাম ছাড়া পুজোর আমেজ! প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে অনুভূতি একই। যেমন একই সীমান্ত পেরিয়ে আসা নদীর জল। বাড়ি মানে গ্রাম। বীরভূম জেলার কীর্ণাহারের অদূরে মিরিটি গ্রামে শিকড়ের টানে প্রণব মুখার্জিও ফিরতেন। ছোটবেলায় জল কাঁদা পেরিয়ে যেখানকার স্কুলে যেতেন সেই পিতৃভূমিতে। যোগ দিতেন পারিবারিক দুর্গোৎসবে। সে এপার আর ওপার হোক বাঙালির আবেগ ও বোধ— অভিন্ন।
প্রণব মুখার্জির জন্ম ১৯৩৫ সালের ১১ ডিসেম্বর। বাবা কামদাকিঙ্কর ছিলেন বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং কংগ্রেস নেতা। বাড়িতে রাজনীতির পরিবেশ দেখেছেন ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু সিউড়ির বিদ্যাসাগর কলেজ বা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর পর্বের ছাত্র থাকাকালীন সময়েও প্রণব রাজনীতিতে জড়াননি। তবে ছাত্র সংসদের সভাপতি হয়েছিলেন। সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেন আরও এক দশক পরে। প্রায় সাড়ে পাঁচ দশকের রাজনৈতিক যাত্রা। ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে উঠে এসে, একের পর এক ধাপ পেরিয়ে, দেশের সর্বোচ্চ পদে তাঁর বসাটা রূপকথার চেয়ে কম কিছু ছিল না তাঁর জীবনে। জীবন শুরু করেছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক হিসেবে।
রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন বেশ পরে। উত্থান পতনের সিঁড়ি বেয়ে জ্ঞান, ধৈর্য্য আর অসীম প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের চাণক্য খ্যাত রাজনীতিবিদ। ১৯৭৩ সালে হন প্রথম উপমন্ত্রী, ১৯৭৪ সালে রাষ্ট্রমন্ত্রী, আর ১৯৭৫ সালে স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী। ১৯৮২ সালে তাঁকে দেশের অর্থমন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেন ইন্দিরা। দ্বিতীয় মনমোহন মন্ত্রিসভাতেও প্রণব অর্থমন্ত্রী ছিলেন, রাষ্ট্রপতি পদে বসার আগে পর্যন্ত। জানা যায়, কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার প্রায় সবগুলি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রকের পাশাপাশি, কয়েক দশক ধরে দলীয় সংগঠনের গুরুদায়িত্বও তিনি সামলেছেন। ইন্দিরা জমানায় ‘মিস্টার ডিপেন্ডেবল’ থেকে সোনিয়া-মনমোহন আমলে ‘মিস্টার ইনডিসপেনসেবল’ হয়ে উঠেছেন। ২০১২ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি হন প্রণব মুখোপাধ্যায়। তবু ভারতে বাঙালির প্রধানমন্ত্রী হওয়া হলো না!
পেয়েছেন ‘পদ্মবিভূষণ’ ও ‘ভারতরত্ন’ পুরস্কার। ১৯৭১ সালে, প্যারিসে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সদস্য হয়ে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে এবং পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। একই সময়ে তিনি যুক্তরাজ্য ও জার্মানি সফরে গিয়েও সেখানকার সরকারকে বাংলাদেশের তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে ভূমিকা রাখেন তিনি। শুধু মুক্তিযুদ্ধে নয় বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বিপন্ন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ও রেহানার পাশেও পরম স্বজন হিসেবে দাঁড়িয়েছেন এই বাঙালি রাজনীতিবিদ। বাংলাদেশ অকৃত্রিম এক বন্ধু হিসেবেই চিরদিন তাঁকে স্মরণে রাখবে।