বিনোদন
ভাওয়াল রাজা কিংবা একটি মানুষের লড়াইয়ের গল্প

মাহমুদুর রহমান: এ ধরনের সিনেমায় আমি সাধারণত ইতিহাস এবং বাস্তব ঘটনার বিশ্লেষণের সঙ্গে সিনেমার তুলনামূলক আলোচনা করি। কিন্তু এই একটা সিনেমার ক্ষেত্রে করবো না। তবু ইচ্ছা ছিল কিছু বিষয় সামনে আনার, কিন্তু সিনেমা দেখার পর বুঝলাম যে সৃজিত আসলে যা দেখাতে চেয়েছেন, তা নিয়েই কেবল আলোচনা করা ভালো।
সিনেমা শুরু হয় রাজা মহেন্দ্রকুমারের শব-বহন থেকে এবং সেখান থেকেই পরবর্তী দৃশ্য চলে যায় আদালতে। কিন্তু আদালত থেকে আবার মুহূর্তেই ফিরে যাওয়া হয় পেছনের গল্পে, অর্থাৎ মহেন্দ্রর তরুণ বয়সের জীবনে। ভাওয়ালের রাজার চরিত্র, ভাওয়াল এস্টেট সম্পর্কে উইকিপিডিয়া কিংবা অন্য অনেক সোর্সে অনেক তথ্য পাবেন। সিনেমায় মহেন্দ্রর বিলাস, রক্ষিতা, মদ্যপ চরিত্র দেখানো হয়েছে। পাশাপাশি দেখানো হয়েছে প্রজাদের জন্য তাঁর ভালোবাসা এবং মনোযোগ।
মেজকুমার মহেন্দ্রর আত্মীয় পরিজন, জীবন যাপন, বিয়ে এবং তাঁর বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্রের বিষয় এই অংশে উঠে আসে। এরপর তাঁর মৃত্যু এবং শবদাহ। তারপর আবার কোর্ট। আদালতে শুনানি চলতে চলতে আমাদের দেখানো হয় মহেন্দ্রর কথিত মৃত্যু, ফিরে আসা এবং তাঁর পরিচয়ের সত্যতা যাচাই। মোটামুটি এই হলো সিনেমার গল্প। অনেক সাদামাটা করেই বললাম, নইলে স্পয়লার চলে আসতে পারে।
এখন সিনেমা, পরিচালনা এবং অভিনয় নিয়ে বলতে হয়। সিনেমার প্রথম অংশ গতিশীল। এবং সে গতির কারনে প্রথম দিকে সিনেমায় ঢুকে পড়া সম্ভব হয় না। একটার পর একটা ঘটনা ঘটতে থাকে। ভাওয়াল রাজার বিলাস, জৌলুস দেখাতে গিয়ে সৃজিত ব্যবহার করেছেন একটি গানের সময়। গানের মাঝেই দেখিয়ে ফেলতে চেষ্টা করেছেন অনেক কিছু ফলে মহেন্দ্রর চরিত্র, ব্যক্তিত্ব ফুটে ওঠে না সেখানে।
সিনেমা মূলত গতি পায় কোর্ট-রুম থেকে। অঞ্জন দত্ত এবং অপর্ণা সেনের শুনানি ও তর্ক বিতর্কের মাঝে উঠে আসে পেছনের গল্প এবং মহেন্দ্রর পরিচয় অন্বেষণ। এখানে এসে একটু একটু করে মহেন্দ্র ফুটে ওঠে, কেবল যীশু সেনগুপ্তর অভিনয় গুণে। সেই সঙ্গে সিনেমা পাকতে শুরু করে। বোঝা যায় যে পরিচালক কেবল একজন ব্যক্তির হক পাওয়ার লড়াইটা দেখাতে চেয়েছেন একটা যাত্রার মাধ্যমে। সেই যাত্রার সঙ্গে সঙ্গে উঠে এসেছে স্বদেশী আন্দোলন, নারী অধিকার, ভাওয়াল এস্টেট তথা ভারতের ভূমির প্রতি ইংরেজদের লোভ। আর দেশীয় রাজার প্রতি তাঁর প্রজাদের আনুগত্য।
এই সিনেমায় ভাওয়ালের সাথে সাথে তৎকালীন ভারতীয় সমাজ, রাজনীতির একটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা দেখা যায় কিন্তু সে জায়গায় পরিচালক যেন সময় দিলেন না। আরেকটু বড় পরিসরে, আরেকটু জায়গা দিলে সেটা পরিস্ফুট হওয়া সম্ভব ছিল।
যীশু সেনগুপ্ত ছাড়া কোন অজ্ঞাত কারনে, কোন চরিত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। অনির্বাণের মতো চমৎকার একজন অভিনেতা, যে কিনা এখানে খলনায়ক, তাঁকে দিয়ে দুর্দান্ত কাজ করানো সম্ভব ছিল, তা হয়নি। জয়া ফুটেও ফুটলেন না। তবে অনেকটা ফুটেছেন অঞ্জন আর অপর্ণা। তাদের সওয়াল জওয়াব আর পূর্ব পরিচয়ের গল্পের মধ্যে উঠে এসেছে অনেক কিছু।
শেষটায় কিছুটা সাসপেন্স রেখেছেন সৃজিত। যিনি ফিরে এসেছেন, তিনি আসলেই মহেন্দ্র, নাকি কোন ভণ্ড, সে প্রশ্ন তুলে রেখেছেন তিনি দর্শকের সামনে। আদালত এবং পরে প্রিভি কাউন্সিলে চলা মামলা নিয়ে মহেন্দ্রর চোখে ফোঁটা উদ্বিগ্ন ভাব দেখে, মহেন্দ্রর লড়াইটা যেন এক মানসিক লড়াইয়ের প্রতিরূপ। কিন্তু তা কেন? সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে দর্শককে।
সিনেমায় সত্য নামধারী অনির্বাণ খলনায়ক হতে হতে যেন প্রতিনায়ক হয়ে উঠলেন। ‘আন্ধাধুন’-এর মতো একটা অসমাপ্ত জায়গায় রেখে দিয়েছেন যেখানে আমরা ভেবে নিতে পারি অনেক কিছু। মূলত ভাওয়াল রাজার কেসটাও ছিল এমনই। সিনেমার একটা সময়ে এসে সৃজিত হঠাৎ একটা বাঁক নিয়ে দর্শককে একটা ধন্ধে ফেলে দিলেন।
যতো গর্জেছিল কিংবা যতটা আশা ছিল, ‘এক যে ছিল রাজা’ তা পূর্ণ করেনি, কিন্তু একটা ছাপ ফেলে গেছে অবশ্যই।