জাতীয়স্বাস্থ্যহেলথ টিপসহোমপেজ স্লাইড ছবি
ভিয়েতনাম কিভাবে সফল?

চীনের প্রতিবেশী ভিয়েতনামে করোনাভাইরাস কবে এসেছিল জানেন? সেই জানুয়ারি মাসের ২৩ তারিখে ভিয়েতনামে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্ত হয়। তারপরে ফেব্রুয়ারি পার হয়েছে, মার্চ পার হয়ে এপ্রিলও পার হওয়ার পথে। এই তিন মাস ৩ তিন দিন পরে ভিয়েতনামে আক্রান্তের সংখ্যা কত জানেন? মৃত্যুর সংখ্যা?
২৬ এপ্রিল পর্যন্ত ভিয়েতনামে মোট আক্রান্ত পাওয়া গিয়েছে ২৭০ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ০ জনের। ২৭০ আক্রান্ত কিভাবে? টেস্ট না করেই কি? ২৬ তারিখ পর্যন্ত দেশটিতে টেস্ট করেছে ২ লাখ ১৩ হাজার। প্রতি মিলিয়নে তারা টেস্ট করেছে ২২০০ এর মত। ফলে, নো টেস্ট নো করোনা নীতি অন্তত তাদের জন্যে প্রযোজ্য না! আক্রান্ত এই ২৭০ জনের মধ্য ২২৫ জনই এর মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে। কিভাবে ভিয়েতনাম কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সফল হলো?
ভিয়েতনামের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে কথা বলাই যায়। ব্যাপকভাবে কোয়ারেন্টাইন, সাধারণ লক্ষণ দেখা দেয়ার সাথে সাথেই তাকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করা, কাউকে শনাক্ত পাওয়ার সাথে সাথেই পুরো এলাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা, সেই শনাক্তের শুধু ফার্স্ট লেভেল না, তার থার্ড এমনকি ফোর্থ লেভেল কন্টাক্ট ট্রেস করে ফেলা- তার বাসের এলাকায়- কর্মস্থলের এলাকায় ব্যাপক টেস্টিং করে অন্য শনাক্ত খুঁজে বের করা, প্রতিটা শহরে, প্রতিটা অফিস-আদালত-ব্যাংকে, প্রতিটি বিল্ডিং এ যেকেউ প্রবেশের আগে শরীরের তাপমাত্রা মাপা, রিসেন্ট মোবিলিটি জানান দেয়া – এগুলো বাধ্যতামূলক করা, এইসব অনেক পদক্ষেপের কথাই বলা যাবে! কিন্তু সবকিছুর মূলে কি ছিল?
আমার মতে, সফলতার মূল জায়গাগুলো হচ্ছেঃ
১/ সরকারের ভয় পাওয়া ও জনগণের মধ্যে ভয় ছড়ানো
২/ নিজেদের সামর্থ্য ও দুর্বলতা নিয়ে সরকারের সঠিক এসেসমেন্ট এবং জনগণকে স্বচ্ছতার সাথে অবহিত করা
৩/ সরকারের ডে-ওয়ান থেকেই করোনা মোকাবেলায় সিরিয়াস থাকা এবং এটাই যে তাদের প্রথম প্রায়োরিটি সেটা জনগণের সামনে বুঝাতে পারায়, জনগণেরও সরকারের পদক্ষেপে পার্ট করা
৪/ সবশেষে, দেশের গবেষণার উপরে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আরোপ করা
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সেই জানুয়ারি মাসেই জনগণের সামনে এসে জানিয়েছে, করোনা আসছে, সবাই সাবধান। এটা সাধারণ ফ্লু ভাইরাস না- তার চাইতেও অনেক ভয়ংকর। এই মেসেজটা তারা বারেবারে দিয়ে গেছে। ৩১ জানুয়ারিতেই তারা ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটা স্টিয়ারিং কমিটি করেছে, যারা করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে!
নিজেদের সবচেয়ে দুর্বলতা হচ্ছে, তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব উন্নত না। দ্বিতীয় দুর্বলতা হচ্ছে- তাদের অঢেল অর্থ নেই যে, রাতারাতি স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পাল্টাতে পারবে। হ্যানয়ের মেয়র পাবলিকলি এড্রেস করে বলেছে, গোটা হ্যানয়ে মানুষ হচ্ছে ৮০ লাখ, অথচ আইসিইউ আছে মাত্র ৯০০ টা। হ্যাঁ, “মাত্র”ই বলেছে! ৯০০ আইসিইউ অনেক না, এটা একেবারেই সামান্য, যা এক্সিস্টিং বিভিন্ন রোগীদের জন্যে অকুপাইড! জানিয়েছে, একবার এই ভাইরাস ঢুকে গেলে যে হাজার-হাজার মানুষ আক্রান্ত হবে, সবাইকে বাঁচানোর সামর্থ্য আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় নাই। আমরা একেবারেই প্রস্তুত না। আমাদের সবরকম সর্বোচ্চ চেস্টা করে চিকিৎসা সুবিধা বাড়িয়েও এই মহামারীর সামনে আমরা অপ্রস্তুতই থেকে যাবো! ফলে, সবার প্রথম প্রায়োরিটি হচ্ছে- এই ভাইরাসকে ঢুকতে না দেয়া, এই ভাইরাসকে ছড়াতে না দেয়া!
তাদের প্রধানমন্ত্রী জনগণের সামনে এসে জানিয়েছেন- এটা একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি। হেলাফেলার কোন ব্যাপার না। প্রতিটা দালান, প্রতিটি অফিস, প্রতিটি বাড়িই এই যুদ্ধে একেকটা দূর্গ। পুরো জনগোষ্ঠীই এই যুদ্ধের যোদ্ধা! সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সাথে জনগণ একমত কি না- এরকম জরিপে দেখা গেছে, একমত হওয়ার হারের দিক দিয়ে ভিয়েতনাম দুনিয়ার মধ্যে উপরের সারিতে অবস্থান করে। পারস্পরিক শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা, সামান্য লক্ষণ দেখা দিলেই জানানো, হাসপাতালের বা ভ্রাম্যমান টেস্টিং বুথগুলোতে গিয়ে টেস্ট করা- এসবে জনগণ সরকারকে সহযোগিতা করেছে। সেই ১১ জানুয়ারি থেকেই ভিয়েতনাম তার এয়ারপোর্ট ও বর্ডারে কড়াকড়ি আরোপ করে দেয়। মার্চের মধ্যেই তারা প্রতি আক্রান্তের ফার্স্ট কন্টাক্টকে কোয়ারেন্টাইনে নেয়ার ব্যবস্থা করে আর সেকেণ্ড, থার্ড কন্টাক্টকে ট্রেস করে তাদেরকে সেলফ আইসোলেশন করতে বলে দেয় (আমরা যেটাকে বলছি হোম কোয়ারেন্টাইন, সেখানে কোয়ারেন্টাইন মানে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন)! এয়ারপোর্টে যারাই দেশে ঢুকেছে- তাদেরকে মিলিটারির তত্ত্ববধানে বসানো কোয়ারেন্টাইন ক্যাম্পে ১৪ দিন রেখেছে। মালয়েশিয়া তাবলীগে অংশ নেয়া মুসলিম ব্যক্তি আক্রান্ত হওয়ার পরে তারা সেই ব্যক্তি যে মসজিদে যেত সেটি বন্ধ করে দেয়। ২১ মার্চ থেকে সমস্ত রকম ইনকামিং ফ্লাইট তারা বন্ধ করে দেয়। হ্যানয়ের একটা হাসপাতাল থেকে যখন একজন ব্যক্তির মাধ্যমে ছড়িয়েছে দেখা গেল, দ্রুত তারা সেই ব্যক্তির গ্রামকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্চিন্ন করে ফেলেছে, এরপরে সেই হাসপাতালকে একটা পর্যায়ে লকডাউন করেছে, সেখানকার ১০০০ স্বাস্থ্য কর্মীকে টেস্ট করেছে, সেই হাসপাতালের ইতিহাস ঘেটে যারাই সেখানে চিকিৎসা নিতে এসেছে- সারাদেশে তাদেরকে ট্রেস করে টেস্ট করেছে। আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে, এসব কিছুই সম্ভব হয়েছে তাদের কঠোর মিলিটারি প্রশাসনের কারণে। কিন্তু, সেখানকার বিশ্লেষকদের মতে – জনগণের সহযোগিতা বাদে এই পদক্ষেপগুলো কেবল ক্ষমতার জোরে করা সম্ভব হতো না! এই জায়গাটাতেই ভিয়েতনাম সরকার সবচাইতে সফল, তারা জনগণকে পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝাতে পেরেছে। বিভিন্ন জরিপে দেখা যাচ্ছে, ভিয়েতনামের স্বৈরশাসকের নিম্নমুখী জনপ্রিয়তা অনেক বছর পরে উপরের দিকে উঠেছে!
আর, গবেষণাকে সবার আগে গুরুত্ব দেয়ার জায়গাটা ছিল এই কোভিড-১৯ মোকাবেলার সবচাইতে বড় হাতিয়ার। সরকারী প্রধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান – ভিয়েতনাম একাডেমি অব সায়েন্স এণ্ড টেকনোলজি দেশের সকল বিজ্ঞানীদের জন্যে এই সময়ে গবেষণার প্রধান চারটি ফোকাস পয়েন্ট জানিয়েছেঃ
– – সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের জিনোম সিকুয়েন্স করা, ভিয়েতনামের জনগণকে যে ভাইরাস আক্রান্ত করছে তার গঠন ও প্রকৃতি বুঝা
– – জনগণ এই ভাইরাসে আক্রান্ত কি না, সেটা শনাক্তের কিট দেশেই তৈরি করা ও উৎপাদন করা
– – সার্স-কোভ-২ ভাইরাসের ভ্যাক্সিন তৈরি করা
– – আক্রান্ত মানুষের চিকিৎসায় এন্টিভাইরাল যৌগ প্রকৃতিতে খুঁজে বের করা
এই চার করণীয়’র মধ্যে একটা পর্যায়ে গিয়ে তারা আবার প্রথম দুটোকে এই মুহুর্তের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে। ফলে, মার্চের মধ্যেই ভিয়েতনামে অন্তত তিনটি টেস্টিং কিট তারা তৈরি করে ফেলেছে, চাহিদাটা যেহেতু উপর থেকে, অনুমোদন ট্রায়াল এসবের জন্যে অযথা সময়ক্ষেপন হয় নাই। ফেব্রুয়ারিতেই ইউনিভার্সিট অব টেকনোলজি, হ্যানয় (UOT Hanoi)- এর বিজ্ঞানীরা আরটি-লাম্প (RT-LAMP) পদ্ধতির কিট আবিস্কার করে ফেলেন, তাদের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হাইজিন এণ্ড এপিওডেমিলগ (NIHE) ভেলিডেট করে। কিটের দাম পড়ে ১৫ ডলার। এর পরে মার্চের শুরুতে ভিয়েতনাম একাডেমি অব সায়েন্স এণ্ড টেকনোলজি (VAST) এর দুই বিজ্ঞানী আরটি-পিসিআর এর কীট দেশেই উৎপাদনের ব্যবস্থা করে ফেলেন। বিদেশ থেকে কিটের অনুরূপ কিট, নতুন কোন আবিস্কার না, কিন্তু সুবিধা হচ্ছে- এর ফলে এই কিট বাইরে থেকে আর আমদানি করতে হচ্ছে না। সেই কিটকে তারা এমনভাবে মডিফাই করেছেন, যাতে ৮০ মিনিটেই টেস্ট কমপ্লিট করে ফলাফল জানা যায়। কিটের দামও কমে এসেছে, মাত্র ২১ ডলার। খোদ মিনিস্ট্রি অব ডিফেন্স দ্রুত এই কিট ভ্যালিডেট করার দায়িত্ব নেয় (মানে ট্রায়াল করা, ট্রায়ালের ফল পাবলিশ করা- পুরা দায়িত্বটা তারা নেয়)! ঐ মার্চেই ইনস্টিটিউট অব মিলিটারি মেডিসিন (IMM) নামের মিলিটারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিডিসি’র আরটি-পিসিআর কিটকে ভিত্তি করে দেশেই আরেকটি কিট তৈরি করে ফেলে। তাদের বিজ্ঞানীরা এতে লজ্জা পাননি, IMM এটা স্বতন্ত্র কোন আবিস্কার না স্বীকার করে বলেছেঃ “because we are behind, our researchers were able to take advantage of [what had been developed] and optimise it”! অপ্টিমাইজ কিভাবে করেছে? এই কিট দিয়ে পরীক্ষার ফল পেতে একঘন্টার কিছু বেশি সময় লাগে, কিন্তু সিডিসির চাইতে চারগুন স্যাম্পল একসাথে টেস্ট করে ফেলা যায়! IMM এই কিট তৈরি করার পরে ভিয়েত-এ (VIET A) নামের একটা কোম্পানি সেই কিটের মাস প্রোডাকশনে গিয়েছে। দ্রুতই তারা দৈনিক ১০ হাজারের বেশি কিট উৎপাদন শুরু করেছে। এরই মধ্যে IMM-VIET A এর এই কিট মালয়েশিয়া, ইরান, ফিনল্যাণ্ড ও ইউক্রেনে এক্সপোর্টও করেছে তারা, আরো ২০টা দেশ এই কিট কেনার জন্যে বসে আছে!
ভিয়েতনাম এরকম গবেষণা করে ফেলতে পারলো কিভাবে? UOT Hanoi, VAST কিংবা IMM এর মত প্রতিষ্ঠানগুলোর সফলতার ভিত্তি কি? তিনটি প্রতিষ্ঠানই রাষ্ট্রীয় এবং তাদের গবেষণার পুরা ফাণ্ডিং করেছে সরকার। এটা হচ্ছে প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। অনুমোদনকারী বা ভ্যালিডেশন দেয়ার যে প্রতিষ্ঠান, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হাইজিন এণ্ড এপিডেমিওলগ (NIHE) নিজেও একটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান, কোন আমলাতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান না। তাদের রিসার্চ ফ্যাসিলিটিজ, ল্যাব সব আছে। দেশের হাসপাতালগুলো এই প্রতিষ্ঠানের সাথে সরাসরি কানেক্টেড, দরকার মতো যেকোন রোগীর যেকোন স্যাম্পল চাইলে যেকোন সময়ে তারা সংগ্রহ করতে পারে! ফলে, ফলে UOT, VAST বা IMM এর বিজ্ঞানীদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ট্রায়াল, ভেলিডেশন, অনুমোদনের জন্যে দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়না! বাইরের সংস্থার অনুমোদনের জন্যেও বসে থাকেনি তারা। IMM-VIET A এর আরটি পিসিআর কিট মাস প্রোডাকশনে যাওয়ার দেড় মাস পরে WHO সেটাকে এপ্রুভাল দিয়েছে!
এই নিজস্ব সক্ষমতা অর্জনের পরেও, ভিয়েতনাম থেমে থাকেনি। তারা দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২ লাখ RAPID টেস্টিং কিট আমদানি করেছে, যাতে একদম মাস লেভেলে টেস্টিং করা যায়। একুরেসি, ফলস নেগেটিভ, ফলস পজিটিভ এসব নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে ৩১ মার্চ থেকে RAPID টেস্ট কিট দিয়ে মাস পাবলিককে টেস্ট করা শুরু করেছে। হাসপাতালগুলোতে বেশি লক্ষণ দেখানো যারা তাদের জন্যে আর কন্টাক্ট ট্রেসিং করে সন্দেহভাজনদের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি পিসিআর কিট দিয়ে টেস্ট আর অল্প লক্ষণে মাস লেভেলে আমদানিকৃত RAPID টেস্টিং কিট দিয়ে টেস্ট, দুটোই প্যারালালি চলছে। ভুল ভাবে পজিটিভ হলে কোন সমস্যা নেই, ১৪ দিন সেলফ আইসোলেশনে থাকছে, ভুলভাবে নেগেটিভ হলেও সমস্যা নেই, লক্ষণ না থাকায় বা কম থাকায় টেস্ট না করলেও যেরকম থাকতো, এখনো সেরকম থাকছে, লক্ষণ প্রকট হলে তো- সাথে সাথেই হাসপাতালে আবার টেস্ট করার সুযোগ থাকছেই! কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ট্রু পজিটিভ যেকজনই মিলছে, তাদের নিয়ে আলাদাভাবে ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে, সেটিই বড় লাভ।এই হচ্ছে- ভিয়েতনামের করোনা যুদ্ধের নানাদিক। পড়ি, আর তুলনা করি। আমাদের দেশটার দিকে তাকাই, আর তুলনা করি! খুব হতাশ লাগে।
- অনুপম সৈকত শান্ত