বাক্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
মীর্জা গালিবের প্রেম বিষয়ক ভাবনা

মিরাজুল ইসলাম: নওয়াবজান দিল্লী’র নামকরা এক বাঈজী। তার গাওয়া গজলের ভক্ত অনেকেই। মায়াবী তার গলার সুর। নওয়াবজান ভক্ত মীর্জা গালিবের কবিতার। গালিবের লেখায় সুর দিতেই তার যাবতীয় আনন্দ। শুধু তাই নয়, গালিবের প্রতি তার প্রেম ঠিক যেন প্রেম ছিল না, তা ছিল ‘জুনুন’ বা আকুতির পর্যায়ে। নিজের সোনার গহনা বিক্রি করে গালিবের ধার শোধ করতেন, হাজী মীরের বই-এর দোকান হতে গালিবের শের লুকিয়ে নিয়ে আসতেন- সন্ধ্যায় সুর দিয়ে সবার কাছ হতে বাহবা কুড়াতেন। সবই গালিবের প্রতি গোপন ভালবাসা’র কারণে। হাতের তালুতে মেহেদী দিয়ে গালিবের নাম লিখে রাখতেন।
একদিন সাহস করে দেখালেনও গালিব’কে। বললেন, ‘দেখুন, আমার হাতে লেখা আপনার নাম শুকিয়ে গেলেও ম্লান হয়ে যায় নি’ গালিব উত্তর দিলেন, “মৃত্যুভয় সারা জীবন ধরেই ছিল। জীবনের রং তাই ম্লান হবার আগেই বর্ণহীন হয়ে গেছে।” গালিবের জীবন হতে এক সময় নওয়াবজান হারিয়ে গেলেও তাঁর জীবন বর্ণহীন হয়ে পড়ে নি। এমন কি তাঁর প্রিয় কেউ ‘বিরহ ব্যথায়’ কাতর হলে গালিব চেষ্টা করতেন তাকে আবার বর্ণিল জীবনে উৎসাহিত হতে। তাঁর কাব্যে বিষাদ-বেদনার ছড়াছড়ি থাকলেও জীবন-ভাবনায় তার অনুবাদ ছিল ভিন্ন।
একবার গালিবের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর ‘গোপন প্রেমিকা’ মৃত্যুবরণ করলে সেই বন্ধু মানসিকভাবে খুব ভেঙ্গে পড়লো। গালিব তাঁর বন্ধুর বেদনা দূর করে তাকে স্বান্তনা দিয়ে এক অমর চিঠি লিখলেন। “ মীর্জা সাহেব, তুমি যে ভাবে দিন কাটাচ্ছো তা আমার মোটেও পছন্দ না। আমার প্রথম যৌবনে আমার এক গুরু আমাকে বলেছিলেন, ‘সংযম সব সময়ের জন্য নয়; আর রিপুকেও সব সময় উপেক্ষা করাও ঠিক নয়। খাও দাও ফূর্তি করো। কিন্তু এটাও মনে রেখো, একটা বুদ্ধিমান মাছি কেবলমাত্র চিনির উপরই বসবে কিন্তু সে তরল মধু’র উপর বসে মজা চাখতে গিয়ে নিজেই আটকে যাবে না।’ আমি তাঁর কথাগুলো মেনে চলার চেষ্টা করি। তুমি আরেকজনের মৃত্যুতে নিজের সর্বনাশ ডেকে আনতে পারো না।
আমি তো মাঝে মাঝে খুবই আতংকে থাকি পরকালের কথা ভেবে। যখন আমার যাবতীয় পাপ-মোচন শেষে আমাকে আমার নির্বাচিত একজন হুরীর সাথে থাকতে দেয়া হবে – তখন কি হবে আমার? এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে? ঐ একই মণিমুক্তা খচিত প্রাসাদ, একই ফলের গাছ, ঘুরে ফিরে সেই একই শান্তির জায়গা। আর খোদা আমার ঐ একই প্রেয়সী হুরী’কে রক্ষা করবেন সব অনিষ্ট হতে শুধু আমারই খেদমতের জন্য। আরে ভাই ওইসব চিন্তা বাদ দিয়ে এখনকার চিন্তা করো, আরেকজন কাউকে দেরী না করে তাড়াতাড়ি নাও। বসন্ত ফেরার আগেই নতুন কোন প্রেয়সীকে নিও, গত বছরের পুরানো পঞ্জিকা এ’বছর ফেলে দিও।
মীর্জা গালিবের এই চিঠি নওয়াবজানের মতো গালিবের প্রেমিকারা পড়েছিলেন নিশ্চয়। তাদের কন্ঠে তাই যুগে যুগে হাহাকার ভরা সুর ভেসে আসে – “দিলে নাদান তুঝে হুয়া ক্যায়া হ্যায় আখির ইস দরদ কি দাওয়া ক্যায়া হ্যায়।” “হে আমার বৈরাগী হৃদয় কি হয়েছে তোমার? আর এই ব্যথার ওষুধই বা কি?