বাক্য
মোবারক খিলজী’র অদ্ভুত প্রেম

মিরাজুল ইসলাম: আলা-উদ-দীন খিলজী দীর্ঘ বিশ বছর দিল্লি শাসনের পর ১৩১৬ সালে মারা গেলে তাঁর ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা মালিক কাফুর পরবর্তী সুলতান হিসেবে নির্বাচন করলেন মালিক শিহাব-উদ-দীন’কে। শিহাব ছিলেন দেবগিরি রাজ্যের রাজকন্যা রামদেভা’র গর্ভে আলা-উদ-দীনের সর্ব কনিষ্ঠ সন্তান। বয়স মাত্র পাঁচ বছর। মালিক কাফুর নিজেও একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান ও খোজা। আলা-উদ-দীন তাঁর বড় ছেলে খিজির খান’কে ১৩১২ সালে পরবর্তী সুলতান হিসেবে ঘোষণা দিলেও প্রধান নিয়ন্ত্রক হিসেবে মালিক কাফুর ছিলেন দিল্লি দরবারের মূল দায়িত্বে।
খিজির খান নিজেও ছিলেন সালতানাতের জন্য অনুপযুক্ত। মদ্যপানে বেঁহুশ থাকতেন সব সময়। মালিক কাফুর শিহাব-উদ-দীন’কে সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত করতে খিজির খান ও তাঁর ভাই সাদী খান’কে অন্ধ করে দিলেন। আরেক ভাই মোবারক খান’কে কারাগারে পাঠালেন। কারণ কাফুরের একান্ত ইচ্ছে নাবালক সুলতানকে সামনে রেখে তিনি রাজ্য চালাবেন। সেই মোতাবেক কারাগারে বন্দী মোবারক খানকে হত্যা করার জন্য ঘাতকদের পাঠালেন কাফুর। রাতের আঁধারে ঘাতক দলের সাথে মোবারক খানের কথা বার্তার নমুনা সংক্ষেপে কল্পনা করছি –
– কে তোমরা? কে পাঠিয়েছে এত রাতে? নিশ্চয় ওই নিমকহারাম কাফুর?
– ঠিকই শুনেছেন। আপনি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হন।
– তার আগে শুধু একবার বলো আমাকে হত্যার বিনিময়ে কি দেবে ওই নপুংশকটা তোমাদের? তার চেয়ে আমার গলার এই হীরা-পান্না-মুক্তা খচিত মালাটা নিয়ে যাও …! লোভ দেখালেন মোবারক খান।
– এই রকম মালা আপনাকে হত্যা করলে আমরা অনেক পাবো।
– কিন্তু আমি তোমাদের যা দেবো তা তো সে দিতে পারবে না।
– কি সেটা? একটু দ্বিধায় পড়লো খুনীর দল।
– তোমাদের আমি আমার খাস আমীর বানিয়ে রাখবো।
– এ তো দেখি ভালোই ঝামেলায় পড়লাম। সম্পদ নাকি ক্ষমতা কোনটা নেব? মালিক কাফুর তো আর আমাদের ক্ষমতা দেবে না। নিজেদের মধ্যে ফিসফাস শুরু হয়ে গেলো।
– তবে শর্ত আছে একটা …। মোবারক খান গলার স্বর নীচু করে বললেন।
– কি সেটা?
– এক্ষুনি গিয়ে ওই মালিক কাফুর ব্যাটার গর্দানটা নিয়ে আসো। তারপর তোমাদের সাথে নিয়ে আমি দিল্লি চালাবো। আমি হবো প্রধান স্বেচ্ছাসেবী দিল্লি মসনদের আর তোমরা হবে আমার সাথী।
মোবারকের সাথে ঘাতকদের সম্মিলিত অট্টহাসিতে অন্ধ প্রকোষ্ঠ কাঁপতে থাকলো। তারা রাজী।
তাই হলো। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ঘুমন্ত কাফুরকে গলা কেটে হত্যা করেছিলো ঘাতকরা। মুক্ত করা হলো আলা-উদ-দীনের তৃতীয় পুত্র মোবারক খিলজী’কে।
ক্ষমতায় বসে মোবারক খিলজী ভাব দেখাতে থাকলেন তিনি তাঁর পিতার যোগ্য উত্তরসূরী। আলা-দীন-খিলজী যেগুলো বাতিল করেছিলেন সব আবার চালু করলেন। সবার মন জয় করতে মুক্ত করে দিলেন সকল রাজবন্দীদের। ব্যবসায়ীদের উপর নানা রকম করারোপ করেছিলেন তাঁর পিতা। সব মওকুফ করে দিলেন। ফলাফল হলো উলটো। জিনিষপত্রের দাম বেড়ে গেল হু হু করে। তাও ঠিক ছিল। রাজ্যে বড় ধরনের অসন্তোষ দেখা দেয় নি। কিন্তু যখন মালিক কাফুরের নির্বাচিত উত্তরাধিকার শিশু সুলতান শিহাব-উদ-দীনের চোখ অন্ধ করে দিলেন মোবারক খিলজি তখন সবাই নড়ে চড়ে বসলো। এমন নিষ্ঠুরতায় সবাই মনে মনে প্রমাদ গুনলো। ক্রমে বোঝা গেলো মোবারক খিলজী কেবল নিষ্ঠুর নন, তিনি ছিলেন মানসিক রোগীর সমতুল্য।
একবার খবর পেলেন তাঁর বড় ভাই খিজির খানের ছেলে তাঁকে সিংহাসন থেকে সরিয়ে দিতে গোপনে ষড়যন্ত্র করছেন। তখন তাকে ডেকে নিয়ে নিজ হাতে হত্যা করলেন। বলা হয়, সেই ছেলেটির মাথা নিজ হাতে পাথর দিয়ে থেঁতলে দিয়েছিলেন। চাচাতো ভাই আসাদ খানকেও সপরিবারে হত্যা করেন একই অভিযোগে। কিছু জ্ঞানী বৃদ্ধ অমাত্য’রা মোবারক খিলজীকে একটু কম পাগলামি করার জন্য জ্ঞান দেবার চেষ্টা করলেন। মুচকি হেসে মোবারক খিলজী তাঁদের একটা নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর সাথে দেখা করার জন্য বললেন। জ্ঞানী অমাত্যরা মহাখুশী। সুলতান নিশ্চয় তাদের পরামর্শ শুনবেন।
নির্দিষ্ট সময় অনুযায়ী তাঁরা দিল্লির দরবারে পৌঁছালে সুলতানের দেহরক্ষীরা তাঁদের প্রাসাদের ছাদের বারান্দার নীচে একসাথে দাঁড় করালো। হঠাৎ মুরব্বীরা টের পেলেন ছাদের উপর থেকে তাঁদের সবার গায়ে অঝোর ধারায় পানি পড়ছে, কিন্তু আকাশে এক ফোঁটা মেঘ নেই! ব্যাপার কি? মোবারক খিলজী তাঁদের অপমান করার জন্য দিল্লির পতিতাদের বারান্দায় সারি বেঁধে দাঁড় করিয়ে জ্ঞানী অমাত্যদের গায়ের উপর মুত্র বিসর্জনের হুকুম দিয়েছিলেন। এই কুকর্মে সহায়তা করেছিলেন মোবারক খিলজীর প্রিয় গুজরাটি বাইজী তাওবা বিবি।
কথিত আছে, এই বাঈজীকে মোবারক খিলজী দায়িত্ব দিয়েছিলেন অশ্রাব্য ভাষায় তাঁর অপছন্দের মন্ত্রী-অমাত্যদের গালিবর্ষণ করার কাজে। শুধু তাই নয় তাঁর প্রিয় বাঈজীকে সম্পূর্ণ নগ্ন অবস্থায় সবার সামনে প্রাসাদে হাঁটাতেন।
তাও যেন ঠিক ছিল। চরম বিপত্তি ঘটলো আরেক জায়গায়। সুলতান প্রেমে পড়লেন এক গুজরাটি সৈন্যের প্রতি। খুবসুরত হিন্দু সৈন্যটি ছিলেন একজন ধর্মান্তরিত মুসলমান। মোবারক ভালোবেসে তাঁর নাম দিলেন খসরুভ। তাঁদের সমকামিতার গল্প ছড়িয়ে পড়লো পুরো হিন্দুস্তানে। ধীরে ধীরে রাজ দরবারে খসরুভের প্রতিপত্তি বাড়তে থাকলো।
আলা-দিন-খিলজী যেভাবে মালিক কাফুরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন তার চেয়েও বেশী মোবারক খিলজী অনুরক্ত হয়ে উঠলেন খসরুভের প্রতি। তাঁর শয্যা সঙ্গীকে নিয়োগ দিলেন সেনাপতি হিসেবে। এক সময় খসরুভ নিজেও দিল্লির সিংহাসনের স্বপ্ন দেখতে লাগলেন। মোবারক খিলজীকে তাঁর অমাত্যদের মধ্যে কেউ একজন সাবধান করতে চাইলে খিলজী উলটো সেই ব্যক্তিকে অন্ধ করে দিলেন। প্রিয় খসরুভের বিরুদ্ধে কোন কথাই তিনি শুনবেন না। ওদিকে হিন্দু রাজা-প্রজারাও খসরুভকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে থাকলেন ও গোপনে ষড়যন্ত্র চলতে থাকলো মোবারক খিলজীর পতন হলে দিল্লির সালতানাত আবার হিন্দু রাজাদের হাতে ফিরে যাবে। অবসান হবে এই উড়ে এসে জুড়ে বসা তুর্কী-আফগানী মুসলিমদের কর্তৃত্ব। আর খসরুভই পারেন এটা সম্ভব করতে। খসরুভ তাদের পরামর্শে দেরী না করে তাঁর গুজরাটি অনুগত সৈন্যদের নিয়ে পরিকল্পনা করলেন মোবারক খিলজীকে হত্যা করার জন্য।
১৩২০ সালে এপ্রিল মাসের যে রাতে মোবারক খিলজীকে হিন্দু গুজরাটি সৈন্য ঘাতক জাহারিয়া হত্যা করলো সেই রাতে একই বিছানায় পাশাপাশি জড়াজড়ি করে ঘুমিয়ে ছিলেন মোবারক ও খসরুভ। মোবারক হয়তো কোন সুন্দর স্বপ্ন দেখছিলেন আর ঘুমের ভান করে খসরুভ অপেক্ষা করছিলেন তাঁরই পাঠানো ঘাতক জাহারিয়া’র জন্য। প্রিয়তমের হাতে নিজ শয্যায় নির্মম ভাবে জীবন হারালেন মোবারক খিলজী।
খসরুভ এরপর দিল্লির নতুন সুলতান হিসেবে নাম ধারণ করলেন নাসির-উদ-দীন খিলজী। এই হত্যাকাণ্ডের বিশদ বর্ণনা ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে। হত্যাকাণ্ডের পরদিন ক্ষমতায় বসে প্রথমেই মৃত মোবারক খিলজীর সকল বেগম–সন্তানসহ পুরো বংশকে হত্যা করে নিশ্চিহ্ন করলেন খসরুভ। এমনকি সুলতানের খেদমতগার দাসী-বাঁদী কাউকে বাদ দিলেন না। দিল্লি দরবার ভরিয়ে দিলেন দেব-দেবীর মূর্তিতে, নিষিদ্ধ করলেন গরু জবাই সহ নানা ধরনের মুসলিম কানুন। আহা! কি বিচিত্র রঙ্গীন ইতিহাস।
কিন্তু অল্প দিন স্থায়ী হয়েছিলো খসরুভের শাসনকাল। সেই বছরই সেপ্টেম্বর মাসে পাঞ্জাবের আরেক মুসলিম সেনাপতি গাজী মালিকের হাতে প্রাণ হারালেন প্রেমিক খসরুভ ওরফে নাসির-উদ-দীন খিলজী। মালিক নতুন উপাধি নিয়ে নাম ধারণ করলেন গিয়াস-উদ-দীন তুঘলক শাহ। অত:পর ৮ই সেপ্টেম্বর, ১৩২০ সাল থেকে শুরু হলো দিল্লিতে তুঘলকী বংশের রাজত্ব।