ব্যবসা ও বাণিজ্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
রতন টাটা: একজন মানবিক ধনী মানুষের গল্প

আরিফুল আলম জুয়েল: সকালে ঘুম থেকে কলিং বেলের শব্দে উঠে যদি দেখেন ভারতের শীর্ষ ব্যবসায়ী রতন টাটা আপনার বাড়ির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে, কেমন অনুভূতি হবে আপনার! আদতে তাই ঘটেছে ভারতের পুনেতে। ভারতের শীর্ষ ধনী রতন টাটার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, সাবেক এক কর্মচারীর বাড়ির সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছেন রতন টাটা। বেশ কয়েক বছর আগে রতন টাটার প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন এক কর্মচারী। গত দুই বছর ধরে তিনি অসুস্থ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিংকডইন-এ ওই ব্যক্তির অসুস্থতার খবর শুনে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন রতন টাটা। ঠিকানা যোগাড় করে বোম্বে থেকে আ কর্মচারীর বাসা পুনের ফ্রেন্ডস সোসাইটিতে যান তিনি।
দরজা খুলতেই কর্মচারী দেখেন তার সামনে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে প্রণাম করছেন রতন টাটা। সেই ছবিটিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল রয়েছে। রতন টাটা সাবেক ওই কর্মচারীর অসুস্থতার খোঁজ খবর নেন। তার চিকিৎসা ও সন্তানদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন। সাক্ষাৎ শেষে ওইদিনই বোম্বে ফিরে যান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সেদিনের ছবিগুলো ছড়িয়ে পড়লে ব্যাপক প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই তাকে ‘জীবন্ত কিংবদন্তী’ ও ‘ভারতে জীবিত সর্বকালের সেরা ব্যবসায়ী’ হিসেবে মন্তব্য করেছেন। সত্যি-ই , কোনো গণমাধ্যমের ক্যামেরা নেই, নেই কোনো নিরাপত্তাকর্মী- কেবলই অনুগত কর্মচারীর প্রতি ভালোবাসা ও প্রতিশ্রুতি আছে।
শুধু কি তাই— ২৬/১১ হামলায় স্বজন হারানো ৮৮০টি পরিবারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন রতন টাটা। সেই পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার খরচ বহন করবেন বলেও জানিয়েছিলেন তিনি। এমনকি বাড়ির বয়স্ক সদস্যদের চিকিৎসার খরচও বহন করেছিলেন। রতন টাটার জীবনের গল্প সিনেমার গল্পকেও হার মানায়। ছোটবেলায় ছিলেন অনাথ আশ্রমে। রতন টাটার জন্ম হয় ১৯৩৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের মুম্বাইয়ে। রতন টাটার বাবা ছিলেন নাভাল টাটা। নাভালের নানী ছিলেন টাটা গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটার স্ত্রী হিরাবাই টাটার আপন বোন। জামশেদজি টাটার ছোট ছেলে স্যার রতনজি টাটা নাভালকে দত্তক নিয়েছিলেন, কারণ তাঁর নিজের কোনও সন্তান ছিল না।
কষ্ট শুরু যখন রতন টাটার বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ ঘটে, তখন রতন টাটার বয়স ১০ বছর, ছোট এক ভাই আর মায়ের আশ্রয় হয় এক অনাথ আশ্রমে। যদিও সেখানে বেশিদিন থাকতে হয়নি, সেখান থেকে তাদের নিয়ে আসেন তাঁর দাদী নবতাজবাই টাটা। ১৯৯১ সালে টাটা সন্স এর তৎকালীন চেয়ারম্যান জে.আর.ডি টাটা অবসরে যাওয়ার সময়ে রতন টাটাকে পরবর্তী চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত করেন। চেয়ারম্যান পদে বসার সাথে সাথেই পুরো কোম্পানী থেকে তিনি চরম বিরোধিতার মুখে পড়েন। কোম্পানীর প্রধান পদাধীকারীদের প্রায় কেউই চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁকে মেনে নিতে চাইছিল না। জে.আর.ডি টাটা কোম্পানীর প্রশাসকদের অতিরিক্ত স্বাধীনতা দিয়ে রেখেছিলেন, ফলে তাদের অনেকেই স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছিল।
এই স্বেচ্ছাচারী অফিসাররাই মূলত রতন টাটার বিরোধীতা করেছিলেন। এই সমস্যার সমাধানে রতন টাটা কোম্পানীতে চাকরির বয়সসীমা বেঁধে দেন – যাতে করে এইসব সিনিয়র অফিসারদের বেশিরভাগই অবসরে যেতে বাধ্য হন। এছাড়া গ্রুপের অধীনে থাকা কোম্পানীগুলোকে নিয়মিত হেড অফিসে রিপোর্ট করার নির্দেশ দেন, এবং সেইসাথে, প্রতিটি কোম্পানীকে তাদের লাভের একাংশ টাটা ব্র্যান্ড বড় করার পেছনে বিনিয়োগ করার নির্দেশ দেন। তাঁর আমলে তিনি টাটা গ্রুপের সব কোম্পানীকে একটি প্রশাসনের আওতায় নিয়ে আসেন। গ্রুপের লবণ ও সফটঅয়্যার ব্যবসাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে আসার উদ্যোগ নেন। তাঁর নেতৃত্বে ২১ বছরে টাটা গ্রুপের আয় ৪০ গুণ বেড়েছিল। আর লাভ বেড়েছিল ৫০ গুণ! রতন টাটা
ছোট বেলা থেকেই বেশ মেধাবী ছিলেন। ১৯৭৫ সালে তিনি হার্ভাড ইউনিভার্সিটির বিজনেস স্কুল থেকে এ্যাডভান্সড ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে একটি কোর্স করেন। আপনি হার্ভাড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, দেখবেন বিশাল এক হল আপনার সামনে দাড়িয়ে আছে, সে হল/বিল্ডিং এর সামনে জ্বলজ্বল করছে একটি নাম- ‘টাটা হল’! হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে খুব অল্পদিন পড়লেও প্রতিষ্ঠানটির প্রতি রতন টাটার দারুন মায়া জন্মেছিল। ২০১০ সালে টাটা গ্রুপ হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলে একটি এক্সিকিউটিভ সেন্টার নির্মানের জন্য ৫ কোটি মার্কিন ডলার প্রদান করে। হলটির নামও দেয়া হয় টাটা হল। এটি মূলত পেশাজীবিদের ব্যবসায়িক শিক্ষার জন্য ব্যবহার হয়। টাটা গ্রুপের বাইরেও তাঁর বেশকিছু বিনিয়োগ রয়েছে। মূলত নতুন সম্ভাবনাময় ব্যবসাতে তিনি এই বিনিয়োগ গুলো করেছিলেন – যার ফলে ব্যবসাগুলো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে।