বাক্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
রবার্ট ওপেনহেইমার : যে নিজেকে বলতেন ‘আমিই মৃত্যু’

আরিফুল আলম জুয়েল: লিটল বয়, ফ্যাট ম্যান, হিরোশিমা, নাগাসাকি এই শব্দগুলো আপনার কাছে খুব পরিচিত মনে হয়! তাই না! মনের কোনে ভেসে উঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার দৃশ্য। বলা হয়ে থাকে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেভাবে বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে সেভাবে আর কোন যুদ্ধ নাড়াতে পারবে না, এমনকি ভবিষ্যতেও না; হোক না সেটা বিংশতম বিশ্বযুদ্ধ!
ফুয়েরার হিটলার কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, হলোকাস্ট সৃষ্টি করে বিশ্বকে জানান দিতে চেয়েছিল তার রাজত্ব। বিশ্বকে দখল করে নেয়ার বিভীষিকাময় ভয়াবহতা তৈরি করেছিল, অবাধে মানুষ হত্যা করে সব দখল করেছিল! হতে চেয়েছিল বিশ্বের শাসনকর্তা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা আসলেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে ‘দ্যা পিয়ানিস্ট’ ছবির সেই দৃশ্য। যে দৃশ্যে এক মহিলা প্রচন্ড খাবারের সংকটে টিফিন বাটিতে করে খাবার নেয়ার সময় আরেকজন এসে সেই খাবারের উপর হামলে পড়ে, খাবারের বাটি নিয়ে টানাটানির এক পর্যায়ে খাবার ছিটকে পড়ে মাটিতে,মাটিতে পড়া খাবারই লোকটি মাটিতে শুয়ে শুয়ে অভুক্তের মত মুখ দিয়েই মাটি থেকে চেটে চেটে খায়! আহা! নিদারুন সে কষ্টের দৃশ্য! এ লেখার উদ্দেশ্য অবশ্য হলোকাস্ট বা খাবারের কষ্ট নয়, উদ্দেশ্য জাপান।
এপ্রিলের ৩০ তারিখ। ১৯৪৫ সালের এই দিনে রহস্যজনকভাবে আত্মহত্যা করেন জার্মান ফুয়েরার এডলফ হিটলার। এরই মাধ্যমে ইউরোপের বুকে চলতে থাকা ছয় বছরব্যাপী ধ্বংসলীলার আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিধ্বস্ত ইউরোপে শেষমেশ ফিরে আসে একচিলতে খুশির ফরমান। রাস্তায় বেরিয়ে আসে মুক্তিকামী জনতা। দেশে দেশে নেমে আসে আনন্দের ঢল। বিশ্বযুদ্ধের রণক্ষেত্র ইউরোপে যখন শান্তির আমেজ, তখন নিশ্চয়ই যুদ্ধসেনাদের স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার কথা। কিন্তু সেটা হতে দেয়নি নাছোড়বান্দা জাপান। যুদ্ধবাজ জাপানিরা নিশ্চিত হার জেনেও যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকলো। তাদের জন্য যুদ্ধে নতি স্বীকার করা চূড়ান্ত অপমানস্বরূপ। প্রয়োজনে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে, তবুও যুদ্ধ থামতে দেওয়া যাবে না। বর্তমান জাপানকে দেখলে মনেই হয় না পূর্বে তারা কোন এক পর্যায়ে এরকম ছিল!

আসলে এরই নাম মনে হয় বিশ্বযুদ্ধ! মিত্রপক্ষের কপালে চিন্তার ভাঁজ দেখা দিলো। কী মুশকিল! নানা উপায়ে যুদ্ধ থামানোর পায়তারা করা হলো, কিন্তু ফলাফল শূন্য। তাই তারা জাপানিদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এমন শিক্ষা দেওয়া হবে, যেন তারা ফের যুদ্ধের নাম নিতে গেলে একশবার ভাবে। এই উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলো এক নতুন বোমা। আগস্টের ৬ তারিখ জাপানের হিরোশিমার বুকে নিক্ষেপ করা হলো সেটি। নাম তার লিটল বয়! সেই বোমা বিস্ফোরণ ঘটা মাত্র শুধু জাপান নয়, পুরো পৃথিবী আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে গেলো। হিরোশিমা যেন এক অতিপ্রাকৃত আক্রোশে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো মুহূর্তের মধ্যে। ক’দিন বাদে ৯ আগষ্ট ফের নাগাসাকিতে আরেকটি বোমা ফেলা হলো। এবার জাপানিদের টনক নড়লো। স্বয়ং সম্রাট হিরোহিতো করজোড় করে যুদ্ধ থামানোর মিনতি করলেন। আত্মসমর্পণ করলো অহংকারী জাপানিরা। যুদ্ধ থেমে গেলো। কিন্তু থামলো না আলোচনা। এই ভয়ংকর বোমা নিয়ে শুরু হলো গুঞ্জন। “কে এই বোমা তৈরি করলো?”

লোকমুখে শুধু এই প্রশ্ন। লোকমুখেই ঘুরতে লাগলো একজনের নাম, “এটি নিশ্চয়ই আলবার্ট আইনস্টাইনের কাজ।” সবাই বিশ্বাস করেও ফেললো, এটি আইনস্টাইন ছাড়া কারো কাজ হতেই পারে না। এমনকি বোমা পতনের ৭৪ বছর পরেও বহু মানুষের কাছে আইনস্টাইন হলেন পারমাণবিক বোমার জনক। এই ঐতিহাসিক ভুলের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় এই বোমার মূল জনকের নাম। আসলে নিউ ইয়র্কের মাটিতে বেড়ে উঠা রবার্ট ওপেনহাইমার নামক এক পদার্থবিদ ছিলেন সেই প্রলয়ংকারী পারমাণবিক বোমার পিতা। যখন জাপানিদের আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিলো আকাশ-বাতাস, তখন এই বিজ্ঞানী বিড়বিড় করে বলছিলেন, “এখন আমি হলাম মৃত্যু, এই পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত ধ্বংসকারী”।
হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখে আতকে উঠেছিল সারা পৃথিবী। আইনস্টাইনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল- “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার হতে পারে?” আইনস্টাইনের উত্তর ছিল- “তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ সম্পর্কে জানি না, তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ যে লাঠি এবং পাথর দিয়ে হবে তা বলতে পারি”। হিরোশিমা ও নাগাসারিকর অবস্থা দেখে পারমাণবিক বোমার জনক ওপেনহেইমারও ব্যথিত হোন। পরবর্তীতে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান উঠেপড়ে লাগলেন হাইড্রোজেন বোমা তৈরির জন্য। অপরদিকে হাইড্রোজেন বোমা আবিষ্কারের বিরোধিতা করেন ওপেনহেইমার। পারমাণবিক বোমার পরিণতি দেখেই তিনি হাইড্রোজেন বোমার বিরোধীতা করেন। কিন্তু এই বিষয়টি ভালো চোখে নেয় নি প্রসিডেন্ট ট্রুম্যান। ফলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ আনা হয় ওপেনহেইমারের বিরুদ্ধে। আমেরিকা রাষ্ট্র যখন ওপেনহেইমারকে নিরাপত্তার প্রশ্নে বিচারের সম্মুখীন করা হয় তখন আমেরিকার জনগণের মনে যে প্রশ্নটির উদয় হল— “ওপেনহেইমার যদি বিশ্বাসী ব্যক্তি না হয় তাহলে বিশ্বাসী ব্যক্তিটি কে?”
এ ঘটনার পর পারমাণবিক বোমার যে প্রকল্প মানে ম্যানহাটন প্রকল্পে কর্মরত ৪৯৩ জন বিজ্ঞানী একযোগে স্বাক্ষর সহকারে ওপেনহেইমারের পক্ষে তাদের প্রতিবাদলিপি প্রেরণ করে। পরে অবশ্য ৯ বছর নির্বাসিত জীবনযাপন করতে হয় তাকে হাইড্রোজেন বোমার বিপরীতে অবস্থানের জন্য। পরবর্তীতে ১৯৬৩ সালে অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট লিন্ডন বি. জনসন ওপেনহেইমারকে আণবিক শক্তি কমিশনের প্রদেয় এনরিকো ফার্মি পুরস্কার প্রদান করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি ইনস্টিটিউট ফর স্টাডি থেকে অবসর নেন। এর পরের বছরই অর্থাৎ ১৯৬৭ সালে গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দেহাবসান ঘটে ‘আমিই মৃত্যু’ বলা মানুষটির!