খেলাহোমপেজ স্লাইড ছবি
রবার্ট জেমস ফিশার : বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু

আরিফুল আলম জুয়েল: শিকাগো, আমেরিকা। ১৯৪৩ সালের ৯ মার্চ ভোরবেলায় দুনিয়ার আলোতে চলে আসলো একটি ছেলে। বিধাতা তাকে পাঠিয়ে হয়তো বলে দিয়েছেন- যা পৃথিবীকে দেখিয়ে দে! ঠিক তাই দেখিয়েছে ছেলেটি! ছেলেটির নাম- রবার্ট জেমস ফিশার ওরফে ববি ফিশার। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ দাবাড়ু!
১৯৬৪ সাল, মাত্র ২১ বছর বয়সে ববি ফিশার একাধারে ৫০ জন ব্যক্তির সাথে দাবা খেলেছেন একসাথে, যার মধ্যে জিতেছেন ৪৭টি, ড্র করেছেন ২টি এবং হেরেছেন বাকি একটি। প্রত্যেকের সাথে একাই একই সময়ে খেলেছেন তিনি।
বুঝুন এবার কি অবস্থা লোকটির, নাম যার ববি ফিশার।
ছোটবেলায় বংশগত দিক বিবেচনা করলে ববি ফিশার যে অনেক বুদ্ধিমান হবেন তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না!
তার মা রেজিনা ফিশার মেডিসিনে পিএইচডি ডিগ্রিধারী একজন চিকিৎসক এবং একইসাথে ছয়টি ভাষায় পারদর্শী।
তার বাবা একজন গণিতবিদ ও পদার্থবিজ্ঞানী, যিনি আইনস্টাইনের পুত্র হান্স-অ্যালবারট আইনস্টাইনের সাথে তার হাইড্রোলজি ল্যাবে কাজ করেছিলেন। ছয় বছর বয়সে ববি ফিশারের প্রথম দাবা খেলায় হাতেখড়ি হয়। প্রথমে সে আর তার বোন জোয়ান ফিশার একসাথে এই খেলা শিখে। এরপর বোনের দাবায় আগ্রহ কমে যাওয়ায় ও মা রেজিনার সময় বের করতে না পারার জন্য ববি নিজেই নিজের সাথে দাবা খেলা চালিয়ে যেতে থাকে।
মাত্র ১৩ বছর বয়সেই তিনি আমেরিকার জুনিয়র দাবা চ্যাম্পিয়ন খেতাব লাভ করেন এবং নিজ দেশের বড় বড় গ্র্যান্ডমাস্টারদের সাথে খেলায় মুখোমুখি হন। ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার রবার্ট বার্নকে এক শ্বাসরুদ্ধকর গেমে হারানোর পর প্রথম একজন বিখ্যাত দাবাড়ু হিসেবে আলোচনায় আসেন ববি ফিশার।
মূলত দাবাই ছিল ববি ফিশারের জীবন। উঠতে-বসতে সে কেবল এক দাবা নিয়েই পড়ে থাকতো। ছোটবেলা থেকেই দাবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন তাকে পেয়ে বসে। সে তাঁর আশেপাশের লোকজনের বলতো- ‘আমার সাথে দাবা ছাড়া আর কেউ কোন কথা বলবে না!’
প্রচন্ড দাবা-পাগল একটি ছেলে ববি। সে একটা ঘরে প্রবেশ করতো যেখানে শুধু দাবা খেলোয়াড়রা থাকতো। এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে দাবার কোনো বই বা ম্যাগাজিন পেলেই বসে পড়তো। সে বলতে গেলে এই বইগুলো একটার পর আরেকটা শুধু গিলতে থাকতো। আর সবকিছু মুখস্থ করে ফেলতো। ১৯৫৭-১৯৬৭ সাল, এই দশ বছরের সময়কালে তিনি টানা আটবার ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপে জয়ী হয়েছিলেন। টানা ১১ বার জিতে তিনি যে ঐতিহাসিক রেকর্ড গড়েন তা আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। এ কারণেই অনেকের দৃষ্টিতে তিনি সর্বকালের সেরা দাবাড়ু।
সবচেয়ে মজার বিষয়- তার সময়ে আন্তর্জাতিক দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে সোভিয়েত ইউনিয়নের একক আধিপত্য ছিল।
তাছাড়া সোভিয়েত ও আমেরিকার মধ্যে চলমান স্নায়ুযুদ্ধের সেই সময়টাতে দাবাকে একরকম জাতির বুদ্ধিমত্তার পরিমাপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। আর রাশিয়া এ ব্যাপারে বড়াই করতে কোনো অংশে কম ছিল না। তাই আমেরিকার তুরুপের তাস ছিল তাদের সেরা গ্র্যান্ডমাস্টার ববি ফিশার। ববি নিজেও রাশিয়ান দাবাড়ুদের বিপক্ষে খেলার জন্য উন্মুখ ছিলেন।
তাদের খেলার সকল ধরন ও প্রক্রিয়া তিনি একেবারে আত্মস্থ করে ফেলেছিলেন।
রাশিয়ানদের উপর এক রকম ক্ষোভ ছিল বলেই রবার্ট ফিশার একের পর এক গ্র্যান্ডমাস্টারদের হারাতে শুরু করেন।
বড় বড় রাশিয়ান গ্র্যান্ডমাস্টারদের তিনি দাবার বোর্ডে বলতে গেলে হেনস্তা করে ছাড়েন। এই মাথা গরম আমেরিকানের কাছে রাশিয়া যেন তাদের দাবার গৌরব হারাতে বসেছিল। তবুও তাদের ভরসা ছিল নিজেদের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন বোরিস স্প্যাসকির উপর। এবার বলবো শ্বাসরুদ্ধকর সেই দ্বৈরথের কথা, যেটিকে বলা হয় দাবার ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক দ্বৈরথ!
জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ১৯তম দাবা অলিম্পিয়াডে ববি ফিশার বোরিস স্প্যাসকির মুখোমুখি হন। শ্বাসরুদ্ধকর সেই ম্যাচে বোরিসই শেষ হাসি হাসেন। এই একজন রাশিয়ানই ববির একটানা জয়ের ধারা ভেঙে দিয়েছিলেন। বোরিস স্প্যাসকির কাছে হারার পর ববির উন্মত্ততা যেন আরো বেড়ে যায়। খেলার সময় তিনি রাশিয়ানদের নানারকম শর্ত জুড়ে দিতে শুরু করেন।
শব্দের প্রতি অনেক সংবেদনশীল ছিলেন এই দাবাড়ু। সামান্য শব্দ তার মনোযোগে অনেক ব্যাঘাত ঘটাত। একেবারে রেগে গিয়ে তিনি খেলার মাঝখানে পরিচালনাকারীদের সাথে তর্কে লিপ্ত হতেন। তাছাড়া তার সন্দেহ প্রবণতাও অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তিনি মনে করতেন তার হোটেলে রাশিয়ানরা মাইক্রোফোন লুকিয়ে তার সব কথা শুনছেন। মাঝে মাঝে হোটেল রুম তছনছ করে ফেলতেন তিনি।
বোরিস স্প্যাসকির সাথে পরবর্তীতে মুখোমুখি হওয়ার সময় নানা রকম শর্ত জুড়ে দিতে থাকেন ববি ফিশার। এসব শর্ত পূরণ না করলে তিনি খেলবেন না তা সাফ জানিয়ে দেন। দাবায় আমেরিকার একমাত্র আশা ছিলেন বলে তার প্রতিনিধিদেরও এই শর্তগুলো উত্থাপনের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া লাগতো। তিনি দর্শকদের প্রথম সারি ফাঁকা রাখার নির্দেশ দেন, নিজের জন্য আরামদায়ক চেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলেন, প্রাইজমানি বাড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেন, গণমাধ্যমকে দূরে থাকার পরামর্শ দেন। এছাড়া তিনি দাবার বোর্ডও পরিবর্তন করতে বলেন। কারণ যে বোর্ডে খেলা হয়, তাতে চাল দেওয়ার সময় তৈরি হওয়া শব্দ তাকে প্রচন্ড বিরক্ত করতো।

বোরিসের বিপক্ষে খেলায় ১-০ তে পিছিয়ে পড়ার পর ববি নতুন অভিযোগ আনেন ক্যামেরা নিয়ে। টেলিভিশনে প্রচারের জন্য যে ক্যামেরা ব্যবহার করা হচ্ছিল তার শব্দে তিনি মনোযোগ ধরে রাখতে পারছিলেন না। ক্যামেরা সরানোর এই দাবী মেনে না নেওয়ায় তিনি তার দ্বিতীয় খেলায় উপস্থিত হননি। এতে বোরিস ২-০ তে এগিয়ে যান। তবে টুর্নামেন্টের আয়োজকরা ববির জেদের সাথে পেরে ওঠেননি। তাছাড়া বোরিসের সম্মতিতেও তারা ববির সকল শর্ত মেনে নেন।
ববির ইচ্ছা অনুযায়ী তৃতীয় রাউন্ডের আয়োজন করা হয় একটা টেবিল টেনিস রুমে।
তৃতীয় গেম থেকে ববি ফিশার তার কারিশমা দেখাতে শুরু করেন। এর পরের প্রত্যেকটা রাউন্ডের একটিতে ড্র ও বাকি সবকটি জিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের মুকুট সোভিয়েত ইউনিয়নের মাথা থেকে ছিনিয়ে আনেন। খেলার এই আকস্মিক পরিবর্তন সোভিয়েতদের রীতিমতো ভয় পাইয়ে দেয়। তারা এই খেলার সাথে আমেরিকার সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি (সিআইএ) জড়িত ছিল কি না তা-ও সন্দেহ করতে শুরু করে। তারা আরো অনুসন্ধান চালায় যে, বোরিসের অরেঞ্জ জুসে কিছু মেশানো ছিল কি না। এমনকি খেলার ঘরের মধ্যে কোনো রশ্মি ব্যবহার করা হয়েছিল কি না তা-ও পরীক্ষা করা বাদ যায়নি।
কি অসাধারন প্রতিভা, অসাধারন মেধা! জীবদ্দশায় ববি ফিশার যেমন মেধাবী ছিল ঠিক ততটাই উন্মাদ ছিল, রগচটা ছিল, অহংকারী ছিল, দাম্ভিক ছিল। রাশিয়ানদের সাথে খেলার জন্য সে বিভিন্ন সময় রাশিয়ানদের বিপক্ষে উসকানিমূলক কথাবার্তা বলতো, গালিগালাজ করতো, রাশিয়ানদের রাগিয়ে দিতো! বিভিন্ন ম্যাগাজিন ও পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি একের পর এক বিস্ফোরণও ঘটান।
এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন যে, মাত্রাতিরিক্ত ইহুদী দাবা খেলায় প্রবেশ করছে। তারা নাকি দাবার জাত নিচের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নারীদের দাবা খেলা নিয়ে কটাক্ষ করতেও তিনি পিছপা হননি। তার মতে, নারীদের দাবা খেলতে দেওয়াই উচিত নয়।
তারা নাকি দাবার ক্লাবগুলোকে পাগলা গারদ বানিয়ে ফেলছে। নারীদের দাবা খেলা নিয়ে একজন মেধাবী দাবাড়ুর মন্তব্য— ‘নারীরা আসলে অনেক দুর্বল। পুরুষদের তুলনায় তারা বেশ বেকুব। তাদের দাবা খেলা উচিত নয়। একেবারেই আনাড়ি তারা। পুরুষদের সাথে খেলা প্রত্যেকটা গেম তারা হেরে যায়।’ ববি ফিশারকে নিয়ে অনেক প্রামাণ্যচিত্র তৈরি হয়েছে। ২০১৪ সালে হলিউডে তার জীবনকাহিনীর উপর ভিত্তি করে ‘পন স্যাক্রিফাইস’ চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়।
২৪ বছর ধরে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের ট্রফি ধরে রাখা সোভিয়েত ইউনিয়নের গৌরব ভেঙে দিতে আগমন ঘটেছিল ববি ফিশারের। 
কিন্তু বয়সের সাথে সাথে তার উন্মাদ হওয়ার মাত্রা যেন বাড়তেই থাকে। নানা গণমাধ্যমে তিনি ইহুদী ও রাশিয়ানদের প্রতি তার ঘৃণা প্রকাশ করতে থাকেন। নিজে একজন ইহুদী হওয়া সত্ত্বেও তার নানা চাঞ্চল্যকর মন্তব্য জনগণ মেনে নিতো না।
সবার সাথে মেলামেশা বাদ দিয়ে তিনি নিজেকে একঘরে করে রাখতেন। এরপর টুকটাক দাবা খেললেও অনেকটা ভবঘুরে হয়ে যান তিনি।
মৃত্যুর কথাটি বলবো এবার, সবাইকেই তো মরতে হয়, সবাই মরবে একদিন। ববি ফিশার ও এর বাইরে নয়! ২০০৮ সালের জানুয়ারি মাসে কিডনির জটিলতার কারণে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল ৬৪ বছর। কাকতালীয় ব্যাপার হলো, দাবার বোর্ডের মোট বর্গাকার ঘরের সংখ্যাও ৬৪। গুনে দেখুন আপনি! ববি ফিশারের জীবনটা আসলেই দাবাময়!