বাক্যহোমপেজ স্লাইড ছবি
শহীদ রফিক ও আড়ালে থাকা অন্যান্য প্রসঙ্গ

সাইফুদ্দিন আহমেদ: ১৯৪৮ সালের ২১মার্চ ও ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিশেষ সমাবর্তন এবং রেসকোর্সের মাঠে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় দেয়া মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ভাষণকে উদ্ধৃত করে দৈনিক আজাদ জানায় -“আমি আপনাদিগকে সুস্পষ্ট ভাবে বলিতে চাই যে, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে ,অন্য কোন ভাষা নহে। যে কেহ অন্যপথে চালিত হইবে সেই পাকিস্তানের শত্রু ।”
জিন্নাহর এই উক্তির বিরুদ্ধে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা অমিত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। অনন্ত ভালবাসায় আগলে রাখে মায়ের ভাষা বাংলাকে। রাজপথ-জনপদে জেগে ওঠা বৈশাখী ঝড়ের মত প্রচণ্ড প্রাণাবেগে ভেসে যায় জিন্না’র দম্ভোক্তি এবং বাংলাকে, বাঙালীকে পদানত রাখার কুটিল বাসনা। ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি রফিক- সালাম-জব্বার-বরকতের মত সূর্যসন্তানদের রক্তের প্লাবনে জেগে উঠে ৫৬ হাজার বর্গমাইল। প্রাণের দাবি “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” হয়ে উঠে স্বাধীনতার ঠিকানা।
১৯৫৬’র ২৯ ফেব্রুয়ারি,পাকিস্তান গণপরিষদে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ২১৪ অনুচ্ছেদে স্বীকার করে নেয়া হয় – “THE STATE LANGUAGES SHALL BE URDU AND BENGAL” পাকিস্তানীদের প্রথম পরাজয় এখানেই ,চূড়ান্ত পরাজয়ের জন্য তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল ১৯৭১পর্যন্ত। ভাষার লড়াই ছিল বাংলা এবং বাঙালীর প্রথম সার্থক লড়াই। আর এই লড়াই ও বিজয়ের এক অন্যতম নায়ক শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ।
শহীদ রফিকের আত্মপরিচয়
শিক্ষা,জ্ঞান আর বিপ্লবের অগ্নিমন্ত্রে উদ্দীপ্ত ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার পারিলে ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহন করেন। ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিকের দাদার নাম মোঃ মকিম। মোঃ মকিমের ঘরে জন্ম নেন জরিপ উদ্দিন, তরিপ উদ্দিন, ওয়াসিম উদ্দিন, আব্দুল লতিফ। এই আব্দুল লতিফই রফিকের গর্বিত পিতা। মা রাফিজা খাতুন।
এদের ঘর আলো করে জন্ম নেন রফিক উদ্দিন,আব্দুর রশিদ ,আব্দুল খালেক ,আব্দুস সালাম , খোরশেদ আলম ,আলেয়া বেগম , জাহানারা বেগম। বাল্যকাল থেকেই রফিক ছিলেন চঞ্চল প্রাণোচ্ছল।
প্রাণোচ্ছলতার শিল্পীত প্রকাশও ঘটেছিল কৈশোরেই। সুঁই-সুতায় নকশা আঁকায় হাত পেঁকেছিল বেশ। রফিকের দূরন্তপনার মূখ্য বিষয় ছিল গাছে চড়া। আর গাছে চড়তে গিয়েই একবার তার পা ভাঙে। চিকিৎসার জন্য সে সময় তাকে কলকাতা পর্যন্তও পাঠানো হয়েছিল। চঞ্চল রফিকের ভবিষ্যত ভেবে তার বাবা তাঁকে কলকাতার মিত্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টেকেনি। ক’বছর পর ফিরে আসেন দেশে। ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় সিংগাইরের বায়রা হাই স্কুলে। এ স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। এরপর কলেজ জীবন। ভর্তি হন দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগে এবং ১ম ও ২য় বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর লেখাপড়া বন্ধ। তবে লেখাপড়া ছেড়ে থাকা তাঁর সম্ভব হয়নি। আবারও ভর্তি হন ঢাকার জগন্নাথ কলেজে। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র থাকাকালেই শাহাদত বরণ করেন তিনি।
কেথায় কিভাবে শহীদ হন রফিক
২১ ফেব্রুয়ারি মামাতো ভাই মোশাররফ হোসেনের সাথে লক্ষ্মীবাজারের দিকে যাওয়ার পথে মেডিকেল কলেজের গেটের কাছে এলে পুলিশ তাঁদের উত্তর দিকে যেতে বাধা দেয় । তখন তাঁরা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনের মধ্যদিয়ে লক্ষ্মীবাজারের দিকে রওনা দেন এবং মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের উত্তর পশ্চিম দিকের গেটের নিকট পৌঁছান। সেখানেও একদল বন্দুকধারী পুলিশকে দেখতে পান তাঁরা। তখন মোশাররফ হোসেন হোস্টেলের ১৩ ও ১৯ নং শেডের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলতে থাকেন। রফিক তখন দাঁড়িয়েছিলেন ২২ নম্বর শেডের কাছে। কিছুক্ষণ পরই একদল পুলিশ হোস্টেলে প্রবেশ করেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। এদের গুলিতে হোস্টেলের বারান্দাতেই নিহত হন রফিক। এ তথ্যগুলো গবেষক বশীর আল হেলাল তাঁর ‘ভাষা আন্দেলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে উলেখ করেছেন। যা শহীদ রফিক হত্যা মামলা থেকে নেয়া।
ভাষা আন্দেলনের প্রথম শহীদ
শতভাগ নিশ্চিত হওয়া না গেলেও এটা মোটমুটি নিশ্চিত যে রফিকই ছিলেন ৫২’র ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে যিনি ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন পুলিশের গুলিতে তার মাথার খুলি উড়ে গিয়েছিল। ১৯৫২’র ২২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল – “ গতকল্য (বৃহস্পতিবার) বিকাল প্রায় ৪ টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি চালনার ফলে বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিকুদ্দিন আহমদের মৃত্যু হয়।”
সাপ্তাহিক নতুন দিন পত্রিকা তাদের ২য় বর্ষ ১৬-১৭শ সংখ্যায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সৈজন্যে শহীদ রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া ছবি ছাপে। বিশিষ্ট গবেষক ও সাহিত্যিক বশীর আল হেলাল তাঁর ‘ভাষা আন্দেলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন -“হয়তো আসলে রফিক উদ্দিন আহমদ প্রথম শহীদ হন। হয়তো তাঁর মাথার খুলিই উড়ে গিয়েছিল ।”
এ গ্রন্থে তিনি তথ্য-উপাত্ত-যুক্তি দিয়ে রফিককেই প্রথম ভাষাশহীদ হিসাবে প্রমান করতে চেয়েছেন।
‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার’ গ্রন্থে ড. রফিকুল ইসলাম ভাষা আন্দোলনকালে ঢাকায় অবস্থানরত শহীদ রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খানের যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন তাতেও প্রমানিত হয় রফিকের মাথার খুলিই উড়ে গিয়েছিল এবং সেইই ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ।
রফিকের লাশ সনাক্তকরণ এবং আড়ালে থাকা কিছু তথ্য
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শহীদ রফিকের মৃতদেহ সনাক্ত করেন তাঁর ভগ্নিপতি মোবারক আলী খান। সময় ছিল রাত ৯ টার মত। সে সময় রফিকের পরনে ছিল হালকা নীল রঙের সার্ট, শাদা ফুলপ্যান্ট, নেভীব্লু রঙের মোজা, চকচকে কালি করা পুরনো ইংলিশ সু। আর ছিল একটি সেফার্স কলম। যে কলম দিয়ে মোবারক আলী খান নিজেও বহুবার লিখেছেন।
প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দুলাহ’র উপস্থিতিতে শহীদ রফিকের জানাজা পড়ান হাফেজ আব্দুল গফুর। তাঁকে কবর দেয়া হয় আজিমপুর কবরস্থানে রাত তিনটায়। পাকিস্তানী পুলিশ নিজেরাই লাশ কবরস্থ করেছিল। আজিমপুর কবরস্থানের অসংরক্ষিতএলাকায় লাশ দাফনের কারনে আজো অজ্ঞাত রয়ে গেছে তাঁর কবর। শহীদ জননী তাঁর জীবৎকালে একটিবারের জন্যও প্রিয়পুত্রের কবরটি দেখে যেতে পারেন নি।
শহীদ রফিক হত্যা মামলা
১৯৫২ সালের ২৮ মার্চ রফিকের মামাতো ভাই মোশাররফ হোসেন খান ঢাকার সদর মহকুমা হাকিম এন.আহমদের এজলাসে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু বিচারক ফৌজদারী দন্ড বিধির ১৩৭ এবং ১৩২ ধারার কথা বলে মামলা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন।
বিয়ের পিড়িতে তাঁর আর বসা হয়নি
১৯৫১ সালের নভেম্বরে নিজ গ্রামের নাসির উদ্দিনের মেয়ে পানু বিবির সাথে রফিকের বিয়ের কথা পাকা হয়। বাবা মায়ের অনুরোধে এ সময় ও বয়সে বিয়েতে রাজি হন তিনি। ৫২’র ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করবার জন্য রফিকের বাবা কর্মস্থল ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি পাড়িল যান। কিন্তু বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হবার আগেই শাহাদাত বরণ করেন রফিক। বিয়ের পিঁড়িতে বসা আর হয়ে উঠেনি তাঁর ।
কালের খড়গ পেড়িয়ে এখনো তাঁর পরিবারের কাছে টিকে আছে শহীদ রফিকের গায়ের পাঞ্জাবী,পরনের লুঙ্গি। স্মৃতির সুবাস ঘেরা এই লুঙ্গি-পাঞ্জাবী এক সময় থাকবে না, হারিয়ে যাবে,মিশে যাবে সময়ের মেঘে মেঘে, গোধূলির ধূসর লগ্নে। কিন্তু রফিক অনির্বাণ দীপশিখাসম জ্বলবে আমাদের বর্ণমালায়, বাউলের সুরে সুরে, হিজল তমালের ছায়ায় ছায়ায়।