আলোচিত যারাজাতীয়ফিচারমতামতমেধাবী মুখ
সুধাংশু স্যারের জন্য শোকগাথা

আরিফুল আলম জুয়েল: খবরটা শুনে স্তম্ভিত বনে গেছি, হৃদয়টা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে, চোখের কোণে অশ্রুকণা জমেই রয়েছে, মাথাটা কাজ করছে না। এমনও ঘটনা ঘটতে পারে বিশ্বাসই হচ্ছে না। সৃষ্টিকর্তা বলে যদি কেউ থেকে থাকেন, তবে ধ্বংসকর্তা বলেও কেউ একজন আছেন নিশ্চয়ই। নইলে এমনটা অন্য কেউ ঘটাতে পারে না। এই মুহূর্তে যদি ঔ ধ্বংসকর্তাকে সামনে পেতাম তবে সদলবলে তার ওপর চড়াও হতাম!
জৈবিক নিয়মে জন্মের পর প্রতিটি মানুষেরই একদিন মৃত্যু হবে তা অবধারিত। তবে কিছু মৃত্যু ঘটে থাকে অনবধারিতভাবে- যা ঘটেছে সুধাংশু স্যারের বেলায়। তাই সঙ্গত কারণেই স্যারের অকাল মৃত্যু তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সহপাঠী, সহকর্মী প্রমুখ সকলকেই বিমূঢ় এবং মুহ্যমান করে তুলেছে। কেউই মানতে রাজি নন তাদের প্রিয় এই মানুষটি না ফেরার দেশে চলে গেছেন।
কারণ মাত্র এত অল্প বয়সে সুস্থ, সবল, কর্মক্ষম, উদ্যম-সমাজকর্মী, শিক্ষক, স্বউদ্যোগে পরোকারী এই মানুষটি হুট করে চিরবিদায় নিবেন তাতো একেবারেই কল্পনাতীত। দক্ষ সরকারি এই কর্মকর্তাকে যারা চেনেন বা জানেন এবং তার সাথে কাজ করা বা চলাফেরার সুযোগ হয়েছে তারা সবাই এক বাক্যে যেমন তার মানবিক গুণাবলীর কথা স্বীকার করবেন, ঠিক তেমনি স্বীকার করবেন তার মেধার কথাও!
আমরা কর অঞ্চল-৩ ঢাকা তে যারা আছি তারা শোকে মূহ্যমান, যদিও সবাই শোকাহত, তারপরও সুধাংশু স্যারের শেষ কর্মস্থলের সহকর্মীবৃন্দ ভাষা হারিয়ে ফেলেছে শোক প্রকাশের! এখানে সবার সাথে স্যারের তাজা স্মৃতি, সেই হাসিমাখা মুখ, সেই বিনয়! আমরা সবাই কোথাও আটকে গেলেই চলে যেতাম সুধাংশু স্যারের কাছে! সেই স্যার আজ নেই- অভাবনীয়, অকল্পনীয়! সুধাংশু স্যারের সাথে কাজ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে! আমি সত্যি ই বিশ্বাস করতে পারছি না এখনো!
সেদিন রাত ১২:৩০, ভয়ে ভয়ে মানসী বৌদিকে ফোন করেছি, বৌদি এবং সাঁঝবাতির কি অবস্থা জানার জন্য। মানসী বৌদি সুধাংশু স্যারের স্ত্রী। আর সাঁঝবাতি স্যারের ৭ বছরের মেয়ে! ফোন করতেই ধরে ফেললেন তাড়াতাড়ি- “ভাই আগেই বলে নেই, সুধাংশু নেই এ কথা বলবেন না, ও আছে! অন্য কথা বলেন!” আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না আর, পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে! আমি নিজেও ভাবছি- আসলেই সুধাংশু স্যার তো আছে, হাসি-খুশি একটা মানুষ, দেখলেই পিঠ ছাপড়ে বলেন- আরিফ, আসো আসো!
বৌদিকে অনেক বুঝালাম, তিনি বললেন- ‘তার মানে আপনি কি বলতে চাচ্ছেন- সুধাংশু নেই! ও আমাকে ছেড়ে কি যেতে পারে! আমি একা একা চলতে পারি না, সুধাংশু ই তো আমাকে বলে- মানসী একা একা চলতে শেখো! আমি শিখিনি, কারন আমার চালাক স্বামী আছে!’ তারপর কান্না অনবরত, কি স্বান্ত্বনা দেবো ভাষা পাচ্ছি না, মুখে আটকে যাচ্ছে সবকিছুই, চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে আমার নিজেরই! এক সাথে কাজ করেছি, হেসেছি, খেলেছিও স্যারের সাথে পিকনিকে গিয়ে! আর শেখার ব্যাপারটা নাই বা বলি, প্রতিনিয়তই শিখেছি স্যারের কাছ থেকে! স্যার কিন্তু ICMAB তেও খুব জনপ্রিয় ছিলেন, বাঁশিও বাজাতেন খুব চমৎকার!
বৌদি বলছে ফোনে- “আমার সাত বছরের মেয়ে সাঁঝবাতি’র এখন কি হবে! মেয়েটা প্রতিদিন ছবি আঁকে তার বাবার জন্য- কবে আসবে বাড়িতে! বাড়িতে আসা মাত্রই হুমড়ি খেয়ে পড়বে ছবি নিয়ে বাবার কোলে! আমি জানি- কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল! সুধাংশু নিজেই তো আমাকে ছাড়া কোনদিনও থাকতে পারেনি, তাহলে সে আমাকে ছাড়া গেল কিভাবে!
ভাই, মেয়েদের বাবা না থাকলে কি হয় জানেন! জানেন না- আমি জানি। আমার বাবা মারা গিয়েছে সেই ছোটবেলায়, প্রতি পদে পদে সমস্যা, বিয়েটা পর্যন্ত হয় না মেয়েদের বাবা না থাকলে! আমার বিয়ের সময় ও প্রবলেম হয়েছে, সুধাংশু আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না বলেই আমাকে বিয়ে করেছে! এখন সে যে গেল আমাকে ছাড়া, কিভাবে থাকবে ভাই বলুন! আমাকে ছাড়া পারবে থাকতে সে !!! সাঁঝবাতির তো বাবা নাই, তাহলে এবার সাঁঝবাতির কি হবে, বলুন ভাই!”
চোখের সামনে ভেসে উঠছে প্রিয় সুধাংশু স্যারের মুখ, প্রিয় আয়েশা মঞ্জিলের পাঁচ তলায় স্যারের অফিস রুম, চেয়ারে বসে হাসছেন! আয়কর বিভাগ সত্যি এক মেধাবী কর্মকর্তাকে হারালো, এ বিভাগের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি! আমি আর কি বলবো- ‘বৌদি শান্ত হোন, ভগবানের কাছে প্রার্থনা করুন যেন ভগবান তাকে স্বর্গবাসী করে! আমরাও প্রার্থনা করছি, পরপারে ভাল থাকবেন অবশ্যই সুধাংশু স্যার।’
সুধাংশু স্যারের প্রিয়মত সহধর্মিনী মানসী বৌদি তার প্রাণপুরুষকে হারিয়ে এবং তাদের সন্তান- সাঁঝবাতি তার আদরের, ভালবাসার পিতাকে অকালে হারিয়ে দুঃখের যে-অকূল সাগরে নিপতিত হয়েছেন, কোনও সান্ত্বনাতেই তা ঘুচবার নয়। পরম করুণাময় তাদেরকে শোক বহনের শক্তিদান করুন- এই প্রার্থনা করছি। অকাল প্রয়াত সুধাংশু কুমার সাহা স্যারের প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণতি ( inclination) এবং তার বিদেহী আত্মার বৈকুণ্ঠলাভ কামনা করছি। আসলে, এমন বিনয়ী, মেধাবী সুধাংশু স্যারদের মৃত্যু হয় না কখনো!