জাতীয়বিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
সুরের পাখির বিদায়

মাহমুদুর রহমান: বাংলাদেশের সংগীত অঙ্গনে যে ক’জন মানুষ প্রতিভা এবং অধ্যবসায়ের সঙ্গে সাধনা করেছেন এবং মানুষকে ভাসিয়েছেন সুরের সাগরে, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল তাদের মাঝে অন্যতম। তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক।
প্রথম জীবনে বুলবুল হোটেল শেরাটনে গিটার বাজাতেন। সেটা ’৬০ এর দশকের কথা। তিনি তখন কৈশোরে। এই দশকের শেষদিকে তিনি নিজের একটা ব্যান্ড তৈরি করেন। বুলবুলের ক্যারিয়ার মূলত শুরু হয় ১৯৭৮ সালে ‘মেঘ বৃষ্টি বাদল’ সিনেমায় সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে। এরপর থেকে তিনি সক্রিয়ভাবে সিনেমায় সংগীত পরিচালনায় রত হন। সেই সঙ্গে তৈরি করেছেন স্বাধীন একক অ্যালবাম।
চলচ্চিত্র এবং সংগীত জগত বুলবুলের উত্থান দেখে ‘নয়নের আলো’ সিনেমায় তার কীর্তি থেকে। এই চলচ্চিত্রের গানগুলোর সুরকার ছিলেন বুলবুল এবং সবগুলো গানই মানুষ পছন্দ করেছিলো, মুখে মুখে ফিরতো। যদিও সিনেমার দর্শকেরা সুরকারের খবর রাখে না, কিন্তু ইন্ডাস্ট্রিতে বুলবুল পরিচিতি পেয়ে গেলেন। ১৯৮৪ সালে বুলবুল বেশকিছু পুরস্কার পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে ভূষিত হয়েছিলেন একুশে পদকে।
এরপর একের পর এক কাজ করতে থাকেন বুলবুল। তাঁর দেওয়া সুরে গান গেয়েছেন সাবিনা ইয়াসমিন, খালিদ হাসান মিলু, অ্যান্ডু কিশোর, কনক চাঁপা, সৈয়দ আব্দুল হাদী থেকে শুরু করে বর্তমান সময়ের অনেক শিল্পী। সেই সত্তরের দশক থেকে এই সেদিন পর্যন্ত তিনি গান লিখেছেন, সুর করেছেন।
বুলবুলের প্রথম জীবনের আরও কিছু কথা না বললেই নয়। তাঁর কৈশোরেই দেশে যুদ্ধ নেমে এসেছিলো। মাত্র ১৫ বছর বয়সে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন তিনি। মূলত তাঁর বড় ভাই ইফতেখার আহমেদ ছিলেন কিংবদন্তী ‘ক্র্যাক প্লাটুন’-এর একজন সদস্য। বুলবুল প্রথমে কিছু গেরিলা অপারেশনে যোগ দেন এবং একাত্তরের জুনে তিনি এটিএম হায়দারের নেতৃত্বে থাকা সেক্টর ২ এ যোগ দেন।
কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কে একটি অপারেশনের সময় বুলবুল পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তাঁকে ক্যান্টনমেন্টে ফায়ারিং স্কোয়াডে নিয়ে যাওয়া হয়। একটি সাক্ষাৎকারে বুলবুল বলেন, “ভেবেছিলাম জীবন এখানেই শেষ তাই আমরা ‘কলমা’ পড়তে শুরু করি। কিন্তু এরপর তারা (পাক আর্মি) সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে”।
এখানে তিনি আরও অনেক মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে বন্দী ছিলেন। ২৭ রমজান, বুলবুল সহ মাত্র চারজনকে বাদ দিয়ে সবাইকে হত্যা করা হয়। এখান থেকে বেঁচে পালিয়ে যান বুলবুল কিন্তু বাড়ি পৌঁছতেই আবার গ্রেপ্তার। দ্বিতীয় দফায় বুলবুলের ওপরে নিয়মিত অত্যাচার করা হয়। বুলবুল বলেন, “এখানে আমাকে সহ সব মুক্তিযোদ্ধাকে অকথ্য নির্যাতন করা হতো। নির্মম নির্যাতনে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়তাম আর জ্ঞান ফিরলে নিজেকে একটা ছোট্ট অন্ধকার কুঠুরিতে খুঁজে পেতাম”।
বুলবুল বীর মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিভাবান সুরকার। কিন্তু দেশের চলমান অবস্থা নিয়ে তাঁর বুকের ভেতরে কষ্ট জমা ছিল। দীর্ঘ আট বছর বাংলাদেশ টেলিভিশনে রাত আঁটটার সংবাদের আগে বুলবুলের সুর করা ‘সব কটা জানালা’ বাজানো হতো। বুলবুল তখন ভেবেছিলেন দেশাত্মবোধক সংগীতের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবেন। বুলবুল বলেন, “অথচ এরজন্য বিটিভি আমাকে একটা পয়সা সন্মানী পর্যন্ত দেয়নি”।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বুলবুল একজন সাক্ষী ছিলেন। আর সেই কারনে তাঁর ভাইকে হত্যা করা হয়। সে সময়ে বুলবুল অত্যন্ত ভেঙে পড়েন। সরকারের কাছে নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়েছিলেন তিনি। নানা সময়ে দুঃখ করেছেন, দুঃখ পেয়েছেন। তবু সংগীতের সঙ্গ ছাড়েননি।
কিন্তু ঈশ্বরের লীলা বোঝা দায়। শুদ্ধতম মানুষটিকে তিনি ডেকে নিলেন। বুলবুল পরপারে চলে গেলেন আজ, ২২ জানুয়ারি ২০১৯। রেখে গেলেন তাঁর সুর করা অসংখ্য গান। আমাদের কাছে সেসবই সম্পদ। আমরা শুনতে থাকবো,
“সব কটা জানালা খুলে দাও না”
“মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে”
“সেই রেল লাইনের ধারে”
“সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য”
“আমার সারাদেহ খেয়ো গো মাটি”
“আমার বুকের মধ্যেখানে”
“আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন”
“আমি তোমারি প্রেমও ভিখারি”
“ও আমার মন কান্দে, ও আমার প্রাণ কান্দে” সহ আর সব গান।
প্রেমের তাজমহল নয়, সুরের তাজমহলে তাঁর কীর্তি ধরা থাকুক। ভালো থাকুন পরপারে।