
মাহমুদুর রহমান: ১৯৫৮ সালে বরিশাল জেলায় জন্ম নেয় একটি ছেলে। তাঁর নাম হানিফ। এ. কে. এমন হানিফ নামের এই ছেলেটি পরবর্তীকালে হানিফ সংকেত নামে সারা বাংলাদেশে, এমনকি দেশের বাইরেও পরিচিতি পায়। সমাজের ছোটবড় নানা অসঙ্গতি নিয়ে কাজ করে হানিফ, মানুষকে সংকেত দেন।
হানিফ প্রথমবার টেলিভিশনে আসেন ১৯৮০ সালে, ফজলে লোহানির বিখ্যাত অনুষ্ঠান ‘যদি কিছু মনে না করেন’-এর মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে হানিফ নিজেই নিজের অনুষ্ঠান তৈরির কাজে হাত দেন। ১৯৮৯ সালে শুরু হয়ে ইত্যাদি আজ অবদি চলছে বাংলাদেশ টেলিভিশনে।
আমাদের সমাজের অনেক মানুষই বারবার চেহারা বদলে ফেলে। এক চরিত্র তাঁর বাইরে, আরেক চরিত্র ভেতরে। এসব নিয়েই হানিফ সংকেতের কাজ। ইত্যাদির মতো স্যাটায়ার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি মানুষের চরিত্রের দ্বিমুখীটা, দুর্নীতি তুলে আনেন রম্যের মাধ্যমে।
ইত্যাদি আর হানিফ সংকেত অবিচ্ছেদ্য নাম। এই অনুষ্ঠানের গ্রন্থনা, পরিচালনা, প্রযোজনা সবই হানিফের নিজের। বাংলাদেশের টেলিভিশন ইতিহাসে কোন অনুষ্ঠানই এতো বছর চলেনি। যেখানে ইত্যাদির বয়স ৩০ বছর। ছোটছোট ‘সেগমেন্টে’ ভাগ করা ইত্যাদির ‘নানা নাতি’, ‘মামা ভাগ্নে’ এখনও মানুষকে আনন্দ দেয়। যদিও সময়ের সাথে সাথে ইত্যাদির আধুনিকায়ন হয়নি, অনেক দর্শক বিমুখ, তবু জরিপে দেখা যায় দেশের ৭৫% এখনও ইত্যাদি দেখে। ইত্যাদির জন্য না হলেও হানিফ সংকেতের জন্য দেখে।
হানিফ সংকেতের সঞ্চালনা অসাধারণ। বাংলাদেশে যে ক’জন মানুষ কথা বলাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছেন, হানিফ তাদের মধ্যে অন্যতম। কথার ভঙ্গী, শব্দ চয়ন সবকিছু মিলিয়ে এই কথার মাধ্যমেই হানিফ সংকেত মানুষকে মুগ্ধ করেন। ধরিয়ে দেন ভুল ত্রুটি। শুধু তা-ই নয়। হানিফ খুঁজে বের করেন অনেক প্রতিভা। ইত্যাদি এবং কেয়া কসমেটিক্সের মাধ্যমে এঁদের স্পন্সর করা হয়। শিল্পী পথিক নবী, আকবর, এমনকি বর্তমান সাংসদ মমতাজও ইত্যাদির মাধ্যমে প্রথম পরিচিতি পেয়েছিলেন।
সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্য, শিক্ষা প্রভৃতি নিয়ে যে একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান থেকে কাজ করা যায়, হানিফ সংকেত তা দেখিয়েছেন। তিনি ইত্যাদির মাধ্যমে পৌঁছেছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। খুঁজে খুঁজে বের করেছেন স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম। নিজে তাদের সাহায্য করেছেন। ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষ তাদের জানতে পেরে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে।
পরবর্তী সময়ে হানিফ সংকেত নাটক তৈরি করা শুরু করেন। সেসব নাটকও সামাজিক সমস্যা, প্রচলিত প্রথার অসারতা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতো। মূলত হানিফের নাটক এটিএন বাংলায় প্রচারিত হতো। ২০০৫ পরবর্তী সময়ে দুই ঈদে হুমায়ূন আহমেদের নাটকের পাশাপাশি হানিফ সংকেতের নাটক সমান জনপ্রিয় ছিল।
হানিফ সংকেত বেশকিছু বইও লিখেছেন। এসব বইও স্যাটায়ার ধরনের। ১৯৯৫ এ প্রথম বই প্রকাশের প্রায় ১৮ বছর পর ২০১৩ সালে দ্বিতীয় বই প্রকাশিত হয়।
সামাজিক অবদানের জন্য হানিফ সংকেত ২০১০ সালে একুশে পদক এবং ২০১৪ সালে জাতীয় পরিবেশ পদক লাভ করেন। এর বাইরেও দেশে বিদেশে হানিফ সংকেত নানা পুরস্কারে পুরস্কৃত হয়েছেন।