বিনোদনহোমপেজ স্লাইড ছবি
হারানো দিনের নায়িকারা

মৃন্ময়ী মোহনা: চলচ্চিত্র কোন দেশের সংস্কৃতির শক্তিশালী ধারক ও বাহক। বাংলাদেশের বর্তমান চলচ্চিত্রের দৈন্যদশা একদিন ছিলোনা। তখন প্রতাপ ছিল দারুণ সব অভিনেতা অভিনেত্রীর। নায়িকারা ছিল সর্বগুণসম্পন্না। রূপের সাথে সাথে অভিনয়ের দক্ষতাও ছিল দারুণ। কিন্তু এখন,’সে যুগ হয়েছে বাসি’ হারানো সেই দিনের নায়িকাদের গল্প আসুন জেনে আসি।
সুমিতা দেবী
সুমিতা দেবী বাংলাদেশের প্রথিতযশা চলচ্চিত্র শিল্পী ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের জনপ্রিয় শিল্পী। সুমিতা দেবী অভিনীত ‘আসিয়া’ ছবিটি ১৯৬০ সালের শ্রেষ্ঠ বাংলা চলচ্চিত্র হিসেবে ‘প্রেসিডেন্ট পদক’ লাভ করেছিল। তার অভিনীত চলচ্চিত্রের সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশটি। বাংলা ছবির পাশাপাশি বেশ কয়েকটি উর্দু ছবিতেও অভিনয় করেছেন তিনি। এছাড়াও, শতাধিক চলচ্চিত্রে সহ-নায়িকা কিংবা পার্শ্ব চরিত্রে অভিনয় করেন। সুমিতা দেবী অভিনীত ছবিগুলো হল -‘কখনো আসেনি’, ‘সোনার কাজল’, ‘কাঁচের দেয়াল’, ‘এই তো জীবন’, ‘দুই দিগন্ত’, ‘বেহুলা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘অভিশাপ’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘সুজন সখী’, ‘আমার জন্মভূমি’ ইত্যাদি। চমৎকার অভিনয় প্রতিভা ও সৌন্দর্যের জন্য বাংলা চলচ্চিত্র তাকে মনে রাখবে সারাজীবন।
শবনম
শবনমের আসল নাম নন্দিতা বসাক ঝর্না। শিশু শিল্পী হিসেবে তিনি ‘আসিয়া’ ছবিতে অভিনয় করেন। ‘শবনম’ নামে নায়িকা হিসেবে তিনি প্রথম অভিনয় করেন মুস্তাফিজ পরিচালিত ‘হারানো দিন’ ছবিতে (১৯৬১)। ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘চান্দা’তে অভিনয় করেন। যা তাকে এনে দেয় তুমুল জনপ্রিয়তা। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। তিনি ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।পাকিস্তানের চলচ্চিত্রে তারপর নিয়মিত হন। এই দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে তার অবদান অনেক।
সুচন্দা
সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘কাগজের নৌকা’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে প্রবেশ তার। ১৯৬৫ সালে জহির রায়হানের ‘বেহুলা’ ছবিতে অভিনয় করেন তিনি। ছবিটি ব্যবসা সফল হয়। তারপর আর থেমে থাকতে হয়নি। সুচন্দা একে একে ‘চাওয়া পাওয়া’, ‘জরিনা সুন্দরী’, ‘আনোয়ারা’ , ‘দুই ভাই’, ‘আয়না’, ‘পিয়াসা’, ‘জীবন থেকে নেয়া’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’, ‘প্রতিশোধ’, ‘জীবন সঙ্গিনী’ প্রভৃতি ছবিতে অভিনয় করেন। তার প্রায় সব ছবিই ছিল দর্শকনন্দিত।
কবরী
তার আসল নাম মিনা পাল। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত ‘সুতরাং’ ছবির মাধ্যমে চলচ্চিত্র জীবন শুরু হয় তার। প্রয়াত অভিনেতা ও পরিচালক আবদুল্লাহ আল মামুন পরিচালিত ‘সারেং বৌ’ ছবিতে অভিনয় করে কবরী অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। কবরী অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘নীল আকাশের নীচে’, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘যে আগুনে পুড়ি’, ‘অবাক পৃথিবী’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘ময়নামতি’, ‘বাহানা’, ‘চোরাবালি’, ‘মতিমহল’, ‘পরিচয়’, ‘রংবাজ’, ‘দেবদাস’, ‘সুজন সখি’, ‘কলমীলতা’ প্রভৃতি। অনেক নায়কের সাথে ছবিতে অভিনয় করলেও রাজ্জাক -কবরী জুটি ছিল সব’চে জনপ্রিয়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতে এখনো এই জুটির মত রোমান্টিক জুটি আসেনি।
শাবানা
মাত্র ৯ বছর বয়সে ‘নতুন সুর’ নামের ছবিতে শিশুশিল্প হিসেবে অভিনয় জীবন শুরু হয় তার। এছাড়া ‘ডাকবাবু’ ও ‘তালাশ’ ছবিতেও তাকে শিশুশিল্পী হিসেবে দেখা যায়। ‘চকোরী’ ছবিতে তিনি নায়িকা হিসেবে পদার্পণ করেন। শাবানার উল্লেখ্যযোগ্য ছবিগুলো হলো ‘আনাড়ি’, ‘সমাধান’, ‘জীবনসাথী’, ‘মাটির ঘর’, ‘লুটেরা’, ‘সখি তুমি কার’, ‘কেউ কারও নয়’, ‘পুত্রবধু’, ‘আক্রোশ’, ‘ভাত দে’, ‘চাপা ডাঙ্গার বউ’ প্রভৃতি। বাংলার সাধারণ নারীর চরিত্রকে তিনি বারবার মহিমান্বিত করে তুলেছেন তার অভিনয় দিয়ে। বর্তমানে তিনি চলচ্চিত্র জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।
ববিতা
১৯৫৩ সালে বাগেরহাটে জন্ম নেওয়া ফরিদা আখতার পপি নামের একটি মেয়েই হলো বাংলা চলচ্চিত্র জগতের জনপ্রিয় নায়িকা ববিতা। ১৯৬৮ সালে নির্মিত ‘সংসার’ ছবির মাধ্যমে যার চলচ্চিত্রের জগতে অভিষেক ঘটে। নায়িকা হিসেবে তার উত্থান ঘটে ‘শেষ পর্যন্ত’ ছবির মাধ্যমে। ১৯৭০- ৯০ সাল পর্যন্ত শতাধিক ছবিতে নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেছেন তিনি। ববিতা অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবির মধ্যে রয়েছে ‘পিচঢালা পথ’ ,‘স্বরলিপি’, ‘ধীরে বহে মেঘনা’, ‘আবার তোরা মানুষ হ’, ‘অশনি সংকেত’, ‘লাঠিয়াল’, ‘নয়নমনি’, ‘অনন্ত প্রেম’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘এতিম’, ‘তিনকন্যা’, ‘রামের সুমতি’, ‘বিরহব্যথ্যা’, ‘বিরাজ বউ’ প্রভৃতি। অনেক নায়কের সাথে ছবি করলেও ববিতা ও জাফর ইকবাল জুটি ছিল সব’চে জনপ্রিয়।
সুচরিতা
বেবী হেলেন নামের মিষ্টি এক মেয়ে শিশুশিল্পী হয়ে পা রাখে সিনেমা জগতে ১৯৬৯ এর দিকে। ১৯৭২ সালে তিনি নায়িকা হিসেবে আবির্ভূত হন। তখন তিনি হয়ে যান সুচরিতা। ১৯৭৭ সালে আবদুল লতিফ বাচ্চু পরিচালিত ‘যাদুর বাঁশী’ ছবিটি তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ছিলো। ব্যক্তিগত জীবনে নায়ক জসিমকে বিয়ে করেন তিনি তবে সেই সংসার বেশি দিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার জনপ্রিয় কয়েকটি ছবি – নায়িকা হিসেবে এরপর একে একে অভিনয় করলেন ‘ডাকু মনসুর’, ‘আপনজন’, ‘মা¯তান’, ‘সমাধি’, ‘আলোর পথে’, ‘গরমিল’, ‘মাটির মায়া’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘নাগরদোলা’, ‘মায়ের আঁচল’ প্রভৃতি।
রোজিনা
রোজিনা চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৭৬ সালে ‘জানোয়ার’ ছবির মাধ্যমে। তার অভিনীত ছবিগুলো হলো ‘হারানো মানিক’, ‘রাজমহল’, ‘অভিমান’, ‘চোখের মণি’, ‘রসেরবাঈদানী’‘সংঘর্ষ,পরদেশী’ ,‘সোহাগ মিলন’, ‘তাসের ঘর’, ‘দুলারী’, ‘আঘাত’, ‘শত্রু’ প্রভৃতি। বাঙালি নারীর চিরায়ত চরিত্রকে তিনি গভীর ভালোবাসার মাধ্যমে মূর্ত করে তুলেছিলেন অভিনয় দিয়ে।
নূতন
নূতনের চলচ্চিত্র জগতে আগমন ঘটে ১৯৭০ সালে মুস্তফা মেহমুদ পরিচালিত ‘নতুন প্রভাত’ সিনেমার মাধ্যমে। তারপর অল্প কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি চলচ্চিত্র জগত থেকে সাময়িক বিদায় নেন। ১৯৭৮ সালে অভিনেতা রুহুল আমিন বাবুলকে বিয়ে করে আবার চলচ্চিত্র জগতে ফিরে আসেন। নূতন তাঁর ২৮ বছরের চলচ্চিত্র জীবনে প্রায় ২০০-এর কাছাকাছি ছবিতে অভিনয় করেছেন। অধিকাংশ ছবিতে তিনি ছিলেন সহ-নায়িকা। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি নৃত্যে দক্ষ ছিলেন। এখনো বিভিন্ন টেলিভিশন অনুষ্ঠানে দেখা যায়।
অঞ্জু ঘোষ
ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার মেয়ে অঞ্জু ঘোষ চলচ্চিত্রে আসেন ১৯৮২ সালে ‘সওদাগর’ ছবির মাধ্যমে। খোলামেলা পোশাকের ধারনা তার মাধ্যমেই শুরু হয়। তিনি তুমুল জপ্রিয়তা পান ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ দিয়ে। তবে পরবর্তীতে তিনি ইন্ডিয়ায় পাড়ি জমান। সেখানে একটি অপেরার দলের সাথে যুক্ত আছেন তিনি।
চম্পা
চম্পা প্রথমে মডেলিং-এর মাধ্যমে তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন এবং টিভি নাটকে অভিনয় করেন। ‘তিনকন্যা’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে চম্পা চলচ্চিত্রের জগত পা রাখেন। তিনি সামাজিক ও অ্যাকশন উভয় প্রকার সিনেমাতে অভিনয় করেছেন, যা তাকে আরও বেশি দর্শকনন্দিত করেছে। তার ১২ বছরের ক্যারিয়ারে তিনি প্রায় ১০০-এর বেশি সিনেমাতে অভিনয় করেছিলেন।
দিতি
১৯৮৪ সালের এফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে’-এর মাধ্যমে নায়িকা পারভীন সুলতানা দিতি পরিচিত হন। ইলিয়াস কাঞ্চন ও সোহেল চৌধুরীর সাথে জুটিবদ্ধ হয়ে দিতি বেশ কিছু ভালো ছবি উপহার দেন। তিনি অভিনয় করেছেন ‘ভাই বন্ধু’, ‘হীরামতি’, ‘দুই জীবন’, ‘সুদ-আসল’ প্রভৃতি ছবিতে। অ্যাকশন সিনেমায় তার ছিল সব’চে দক্ষ বিচরণ।
শাবনাজ
৮০ দশকের শেষভাগে চলচ্চিত্রে আসেন নায়িকা শাবনাজ। তিনি বেশ কিছু ছবিতে অভিনয় করেছেন। যার মধ্যে ‘চাঁদনী’, ‘অঞ্জলী’, ‘সাক্ষাত’, ‘ডাক্তার বাড়ি’ উল্লেখযোগ্য। তবে অভিনেতা নাঈমকে বিয়ে করার পর তিনি চলচ্চিত্র জগত থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন।
মৌসুমী
‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ ছবির মাধ্যমে মৌসুমীর রুপালী পর্দায় আগমন। মৌসুমী অভিনীত জনপ্রিয় ছবির মধ্যে রয়েছে ‘দেনমোহর’, ‘গরীবের রানী’, ‘মেহের নিগার’, ‘বিশ্বপ্রেমিক’, ‘আম্মাজান’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘খাইরুন সুন্দরী’, ‘এক কাপ চা’, ‘প্রজাপতি’ প্রভৃতি। বাংলা চলচ্চিত্রের আবেদনময়ী নায়িকা হিসেবে তাঁর প্রতাপ ছিলো। তিনি বর্তমানে নিজের প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত আছেন।
শাবনূর
৯০ দশকে এই জনপ্রিয় নায়িকা বাংলা চলচ্চিত্রে পদার্পন করেন। শাবনূর অভিনীত প্রথম ছবি ‘চাঁদনী রাতে’। প্রয়াত নায়ক সালমান শাহর সঙ্গে গড়ে ওঠা তার জুটি দর্শকদের গ্রহনযোগ্যতা পায়। শাবনুরের উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হলো – ‘তোমাকেই চাই’, ‘বিক্ষোভ’, ‘আনন্দ অশ্র’, ‘ সুজন সখী’, ‘ভালবাসি তোমাকে’, ‘মন মানে না’, ‘দুই নয়নের আলো’ প্রভৃতি। এখন পর্যন্ত তার মত ‘ভার্সেটাইল’ অভিনেত্রী বাংলা চলচ্চিত্র জগতে আসেনি। বর্তমানে সংসারধর্ম নিয়ে তিনি ব্যস্ত আছেন।তবে দর্শকরা এখনো তাকে রুপালী পর্দায় দেখতে চায়।