আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণচলতি হাওয়াহোমপেজ স্লাইড ছবি
হ্যাগিয়া সোফিয়ার আদ্যোপান্ত

মিরাজুল ইসলাম: আহলে কিতাবধারী দুই ধর্মে সহিষ্ণুতার প্রতীক হিসেবে তুরস্কের ইস্তানবুল নগরীর বাইজেন্টাইন চার্চ ‘হ্যাগিয়া সোফিয়া’ ভিন্ন কারনে আমার কাছে এক আকর্ষণীয় স্থাপত্য নিদর্শন। তাছাড়া বাইজেন্টাইন মোজাইক শিল্পকলার সর্বোত্তম নিদর্শন রয়েছে এই হাজার বছরের পুরানো চার্চটির দেয়াল-ছাদ- খিলান জুড়ে। খৃস্টান ধর্ম-বিশ্বাস ঘিরে প্রচুর উপকথা ও নিদর্শন ছড়িয়ে ও জড়িয়ে আছে চার্চটির প্রতিটি অংশে। হাজার বছরের ইতিহাস যেন পরিভ্রমণ করা যায় হ্যাগিয়া সোফিয়ার সোনার পাতে মোড়ানো ছাদের নীচে দাঁড়ালে।
আমার দৃষ্টিতে তুর্কী ‘হিপোক্রেট’ প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়িপ এরদোয়ান নিজেকে একজন ঐতিহাসিক মুসলিম সেনা শাসকদের বিজয়ী উত্তরসূরী মনে করেন। তাঁর বিশ্বাস ‘অদৃশ্য ক্রুসেড’ এখনো চলছে। এর প্রমাণ রাখতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাইজেন্টাইন চার্চটিকে মসজিদে রূপান্তরের মাধ্যমে নিজেকে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই দেবার সুযোগটা তিনি কাজে লাগালেন। তার আগে গণতান্ত্রিক তুরস্কের প্রথম প্রেসিডন্ট মোস্তফা কামাল আতার্তুক চার্চটিকে খৃস্টান এবং ইসলাম কোন ধর্মের অধিকারের আওতায় না দিয়ে একে মিউজিয়ামে রূপান্তরিত করে আপাতত বাহবা কুড়িয়েছিলেন গোটা পশ্চিমা বিশ্বে।
এখন পরিবর্তিত বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সুযোগ কাজে লাগিয়ে এরদোয়ান সেটিকে আবার মসজিদে কনভার্ট করে মুসলিম বিশ্বে তাঁর অবস্থান সমুন্নত রাখার চেষ্টা করলেন। সুতরাং তুরস্কের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার ফলাফল, কামাল ১ – এরদোয়ান ২। মোস্তফা কামাল কিংবা এরদোয়ান হয়তো ইতিহাস বেশী বোঝেন কিংবা ইতিহাস থেকে কিছুই শিখতে পারেন নি। তাঁরা উভয়ে তাঁদের পূর্বসূরী অটোমন সুলতানদের সিদ্ধান্তের দায়ভার নিজেদের ইচ্ছেমতো পালন করে গেলেন। হ্যাগিয়া সোফিয়া’র ঐতিহাসিক গুরুত্বকে উহ্য রেখে কামাল ও এরদোয়ান দুজনেই এই চার্চকে ঘিরে উদার পশ্চিমা মুখাপেক্ষী রাজনৈতিক দর্শন বনাম উগ্র প্যান ইসলামিক জাতীয়তাবাদের যে নিদর্শন রাখলেন তাতে ক্ষুণ্ণ হলো একটি ঐতিহাসিক স্থাপনার।
সর্বশেষে এরদোয়ান যে পদক্ষেপটি নিলেন যার কারনে এখন বলাই যায়, তিনি নরেন্দ্র মোদী’র কাতারে নিজেকে নিয়ে গেলেন। গত শুক্রবার প্রায় ৮৪ বছর পর জুম্মা’র নামাজ আদায় করা হলো ‘হ্যাগিয়া সোফিয়া’ মসজিদে। তবে সর্বপ্রথম ১৪৫৩ সালের ২৯ মে অটোমন সুলতান ২য় মোহাম্মেদ কনস্ট্যান্টিপল শহর অধিগ্রহণ করে চার্চটিকে মসজিদে রূপান্তর করেছিলেন। সেই সময় ঘটে যাওয়া একটা ঘটনা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক। সুলতান মোহাম্মেদ মাত্র ২১ বছর বয়সে তৎকালীন ইস্তানবুল নগর জয় করেন। যুদ্ধ জয়ের পর তাঁর অন্যতম আকর্ষণ ছিল ঐতিহাসিক নয়নাভিরাম হ্যাগিয়া সোফিয়া পরিদর্শন করা।
যখন তিনি ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ চার্চে প্রবেশ করলেন দেখতে পেলেন একজন তুর্কী সৈন্য চার্চের মেঝে খুঁড়ে ভেতরের সৌন্দর্য নষ্ট করছে। সুলতান তাকে জিজ্ঞাসা করলেন কেন সে এই কাজটি করছে। যুদ্ধ বিজয়ী গর্বিত সেলজুক সৈন্যটি জবাব দিল, ‘আমার ধর্ম বিশ্বাসের জন্য এটা ধ্বংস করা দরকার।’ সাথে সাথে সুলতান মোহাম্মেদ ক্ষুব্ধ হয়ে সৈন্যটিকে তাঁর তরবারি দিয়ে সজোরে আঘাত করে বলেছিলেন, ‘তোমার জন্য যুদ্ধজয়ে সোনা-দানা আর যুদ্ধবন্দীরাই যথেষ্ট, কিন্তু কোন সাহসে তুমি আমার জয় করা এতো সুন্দর ভবনে হাত লাগাও?’ ইতিহাসবেত্তা ডুকোস লিখেছিলেন, ‘এরপর ঐ সৈন্যটিকে অর্ধমৃত অবস্থায় টেনে হিঁচড়ে চার্চের বাইরে ফেলে দেয়া হয়।’ বলা বাহুল্য এরপর চার্চটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করা হলেও এর অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য বিনষ্ট করতে কেউ সাহস পায় নি। ( সূত্র – হ্যাগিয়া সোফিয়া, লর্ড কিনরস)
তবে এরদোয়ান চার্চটি ধর্মীয়ভাবে অধিগ্রহণের পর শিল্পপ্রেমীদের মধ্যে একটা ভীতি কাজ করছিল। অষ্টম থেকে ত্রয়োদশ শতাব্দী পর্যন্ত মোজাইক ও রিলিফ শৈলীতে যে সমস্ত চিত্রকলা হ্যাগিয়া সোফিয়ার সারা শরীর জুড়ে আঁকা আছে তার ভবিষ্যত কি হবে? কারন ইসলামের দৃষ্টিতে তো নর-নারীর ফিগারেটিভ ছবি আঁকা গর্হিত কাজ। তাও আবার সেটা যখন এরদোয়ান আমলের মসজিদ। বিশেষ করে আবার সেখানে অংকিত রয়েছে গ্যাব্রিয়াল বা জীবরাঈল (আঃ)-এর প্রতিকৃতি। খৃষ্টীয় তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাইজেন্টাইন শিল্পীরা তাঁকে এঁকেছিলেন নারী সৌন্দর্য্যের মহিমায়। তাছাড়া রয়েছে স্বয়ং যীশু খৃষ্ট, মাদার মেরী ও তাঁর কোলে শিশু যীশু, সাধু জন দ্যা ব্যাপটিস্টসহ বিভিন্ন সময়ের বাইজেন্টাইন শাসকদের মোজাইককৃত ছবি।
তবে আমরা আশ্বস্তের সাথে প্রত্যক্ষ করলাম, এরদোয়ান সরকার চার্চের ভেতর নামাজ পড়া মসজিদের অভ্যন্তরভাগের চিত্রকলাগুলোকে ধ্বংস করেন নি। আমরা মুমিন’রা যেমন ড্রয়িং রুমে নামাজ পড়ার সময় অনেকে দেয়ালে ঝুলানো ছবিগুলো ঢেকে রাখি, ঠিক তেমনি বিশাল সাদা কাপড়ে সেই মোজাইক ছবিগুলো আবৃত করে রাখা হয়েছে। দেখে অনেক স্বস্তি হলো এই ভেবে আর যাই হোক আফগানিস্তানের বামিয়ান তালিবানদের মতো হঠকারী বর্বর সিদ্ধান্তে অন্তত ন্যাটো সদস্য তুর্কীরা নেয় নি। চার্চের এই ছবিগুলো ঢেকে রাখার প্রসঙ্গে কিছু ঐতিহাসিক তথ্য মনে পড়ছে।
চিত্রকলা নিয়ে হযরত মুহম্মদ (সা:)-এর জীবনীকার ইবনে সাদ (অষ্টম শতক) লিখেছিলেন, ‘তাঁর (রাসুলের) শেষবার অসুস্থতার সময় বিছানার পাশে সকল পত্নীরা ঘিরে বসে আবিসিনিয়ার একটি চার্চে যে সব ছবি দেখছিলেন, তাই নিয়ে আলোচনা করছিলেন। বিশেষ করে উম্মে সালমা ও উম্মে হাবিবা আবিসিনিয়া হতে সদ্যপ্রত্যাগতা। তাঁরাই চার্চের সৌন্দর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করছিলেন। পয়গম্বর আলোচনায় যোগ দিয়ে বলেন, ওদের প্রথা হল, কোন সাধুপুরুষের মৃত্যু হলে তাঁর কবরের ওপর প্রার্থনাঘর তৈরী করে দেয় এবং দেয়ালে ওইসব ছবি আঁকে। তবে ঈশ্বরের চোখে ওরা দুর্বৃত্ত।’
আরজাকি নামে মক্কার ইতিহাসকার লিখেছেন, ‘মক্কাজয়ের পর পয়গম্বর কাবাগৃহে ঢুকে সব ছবি ঘষে মুছে ফেলার আদেশ দেন। দেয়ালে আঁকা ছিল শিশু পয়গম্বর ইসাকে নিয়ে তাঁর মা মরিয়ম (মেরী)–এর ছবি। পয়গম্বর সেই ছবিতে হাত রেখে বলেন, আমার হাতের তলায় যেটি আছে, সেটি ছাড়া সব ছবি ঘষে মুছে ফেলো।’ ওই ছবিটি রয়ে যায়। ৬৮৩ খিষ্টাব্দে খলিফা-বিরোধী আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইরকে বন্দী করার জন্য যখন উম্মিয়া বংশীয় খলিফা ইয়াজিদের সেনাবাহিনী মক্কা নগরী অবরোধ করে এবং আগুন জ্বালিয়ে দেয়, তখন কাবাগৃহের ওই ছবিটি পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়।
আরব ঐতিহাসিক আরজাকি ৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ এই বিবরণ লিখেছেন। (সূত্র: “মুসলিম চিত্রকলার আদিপর্ব ও অন্যান্য” – সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ) তবে ইতিহাস সাক্ষী দেয় বাইজেন্টাইন শাসকদের সবাই চার্চটির শৈল্পিক সৌন্দর্য যথাযথভাবে সংরক্ষণ করেন নি। বিশেষ করে অষ্টম ও নবম শতাব্দীতে খৃষ্টানদের মধ্যে তখন নীতি ও সাধু’দের মধ্যে অনেক মতভেদ চলছিল। ইতিপূর্বে ৩৬১ থেকে ৩৬৩ সালে ক্ষমতায় থাকা রোমান সম্রাট জুলিয়ান যেহেতু দেব দেবীর মূর্তি পূজারী ছিলে তাই এক শ্রেণীর খৃস্টান রোমান পৌত্তলিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলো। তাদের লক্ষ্য ছিল দেব দেবীর মূর্তি ভাঙ্গা। হাতুড়ি হাতে এই মূর্তি ভাঙ্গাভাঙ্গি চললো আরো সাতশো বছর।
অনেক ভাস্কর-স্থপতি–শিল্পী তখন ইস্তানবুল ছেড়ে পশ্চিম ইউরোপে পাড়ি জমালো। যারা মূর্তি ভাঙ্গতো তাদের বলা হতো আইকনোক্লাস্ট। মূর্তির লক্ষণকে তারা বলতো আইকনোগ্রাফি। যেখানে রোমান যুগের ‘রিলিফ এণ্ড বাস্ট’ ঘরাণার মূর্তি দেখতো সেখানেই আক্রমণ চালাতো পৌত্তলিক বিরোধী খৃষ্টান ধার্মিকেরা। ৭২৬ সালে সম্রাট ৩য় লিও ক্ষমতায় আসার পর হ্যাগিয়া সোফিয়া চার্চের কয়েক দফা ক্ষতি করেন। তিনি নিজে কনস্ট্যান্টিপলে তাঁর প্রাসাদের প্রবেশ মুখে রক্ষিত যীশু খৃষ্টের বিশাল মূর্তি ভেঙ্গে ফেলেন। তাঁর ছেলে পরবর্তী সম্রাট ৫ম কনস্ট্যান্টিন একইভাবে যাবতীয় মূর্তি ও অবয়বাকৃতির শিল্পকলার ঘোর বিরোধী ছিলেন।
এরপর নতুন বাইজেন্টাইন সম্রাট থিওফিলাস ডিক্রি জারী করেছিলেন, প্রতিটি চার্চে সাধুদের মূর্তি ধ্বংস করতে হবে এবং তার স্থলে পশুপাখি অংকন করা যাবে।’ ৮৪২ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থিওফিলাসের মৃত্যুর পর আক্ষরিক অর্থে আইকনোক্লাস্ট মতবাদের সম্রাটদের যুগের অবসান হয়। নতুন সম্রাট জাস্টটিনিয়ান ক্ষমতায় আসার পর আবার হ্যাগিয়া সোফিয়া’র অভ্যন্তরীণ নান্দনিক সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ শুরু হয় নতুন উদ্যমে। তা অব্যাহত থাকে একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দী অব্দি। ততদিনে অবশ্য ক্রুসেড শুরু হয়ে গেছে। হাত বদলের অপেক্ষা শুরু হলো তখন থেকে বসফরাসের অপরূপা হ্যাগিয়া সোফিয়া’র।